খসরু পারভেজ

শিক্ষকতার মতো মহান পেশা নিয়েই শুরু হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কর্মজীবন। কবি হিসেবে তিনি মেধাবী ও শক্তিমান ছিলেন; শিক্ষক হিসেবেও তার কৃতিত্ব কম নয়। ভালো ইংরেজি জানতেন তিনি। শুধু ‘ভালো’ বিশেষণটা ব্যবহার করলে অবিচার করা হবে; তার সময়ে তার মতো ভালো ইংরেজি জানা বাঙালীর সংখ্যা ছিল নগন্য। তবে স্কুলে তাকে শুধু ইংরেজি পড়াতে হতো না। তাকে ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা সাহিত্যসহ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাইবেলও পড়াতে হতো।

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মধুসূদন কলকাতার বিশপস কলেজ ছেড়ে ভাগ্যোন্বেষণে মাদ্রাজ রওনা হন। কুড়ি দিন সমুদ্রপথে অবস্থানের পর ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি মাদ্রাজ উপকূলে পৌঁছান তিনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে অথবা মার্চ মাসের প্রথম দিকে মাদ্রাজ শহরে অবস্থিত মাদ্রাজ মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম ১ স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন মধুসূদন।

সে সময়ে মাদ্রাজে বাঙালিদের বসবাস কম ছিল। খ্রিষ্টান মধুসূদন এখানকার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বিশপস কলেজে তার বন্ধু এগবার্ট কেনেট আগেই মাদ্রাজে ফিরে এসেছিলেন। মধুসূদন বিশপ হতে চেয়েছিলেন। কলকাতা অবস্থানকালে মাদ্রাজের একজন বিশপের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল। যে বিশপ তাকে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। এই বিশপের ওপর ভরসা করেই মধুসূদন মাদ্রাজ আসেন। কিন্তু মধুসূদনের ধর্মীয় চেতনা সম্পর্কে বিশপদের ধারণা খুব উঁচু ছিল না। তারা মধুসূদনের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে যে অধিক আগ্রহ দেখেছেন, তা একমাত্র নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য, এটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন। অধ্যাপক স্ট্রিটের কথায় ’এ এক আত্মপ্রবঞ্চিত মধুসূদন।’ তাই মাদ্রাজের বিশপরা তাকে যাজক হওয়া বা অন্য কোনো চাকরির ব্যাপারে খুব সাহায্য করেননি, এটা স্পষ্ট। তবে কে তাকে সাহায্য করেছিলেন স্কুলের চাকরির জন্য? গবেষক গোলাম মুরশিদ জানিয়েছেন...

‘তার মাদ্রাজ যাওয়ার কথা তিনি দু-তিন জনকে বলেছিলেন। এই দু-তিন জনের মধ্যে একজন ছিলেন মি. টমাস ডিয়ালট্রি।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মাদ্রাজের বিশপ তাকে সাহায্য করেছিলেন বলে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে তিনি সেখানে সাহায্য পেয়েছিলেন অন্য সূত্র থেকে, কেনেট পরিবার থেকে। এগবার্ট কেনেট তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাইকেলকে কোনো চাকরি দেওয়ার সম্ভব হবে কিনা, এ নিয়ে এগবার্ট এবং তার পিতার মধ্যে আগেই আলাপ হয়েছিল। এ প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এগবার্ট কেনেটের পিতা চার্লস কেনেট ছিলেন অরফ্যান অ্যাসাইলামের সেক্রেটারি। মাইকেল এই অ্যাসাইলামের বয়েজ স্কুলের ‘আশার’ অর্থাৎ সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন। মাইকেলের চাকরি নিতান্ত সাধারণ এবং তার বেতন অথবা সম্মান কোনোটাই স্পর্ধা করার মতো নয়। কিন্তু একটা অপরিচিত জায়গায় কোনোমতে মাথা গোঁজার ব্যাপারে পরিবেশ তার জন্যে বেশ অনুকূলে ছিল। অনুকূল ছিল না তার ভাগ্য। তিনি সেখানে গিয়ে স্থির হয়ে বসতে না বসতেই তার বসন্ত হয়েছিল। তখন যে অপরিচিত বিভূঁইয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যাননি, তা থেকেও পূর্ব পরিচিতদের সাহায্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।’ গোলাম মুরশিদ মাদ্রাজে মধুসূদনের প্রতিষ্ঠায় তার বন্ধু কেনেটের যে অবদানের কথা বলেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেননা মধুসূদন মাদ্রাজ থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে চিঠিতে জানিয়েছেন, ‘এখানে (মাদ্রাজে) এসে পৌঁছানোর পর থেকে একটু দাঁড়াবার জায়গা খোঁজ করবার জন্য আমাকে অনেক প্রকার চেষ্টা করতে হয়েছে। এ কথা মনে রেখ, একজন স্বজনহীন অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির পক্ষে এ কাজ খুব সহজ নয়। যা হোক ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, আমার দুর্দশা কিছুটা দূর হয়েছে। এখন আমি নিজেকে এভাবে ভাবতে শুরু করেছি যে, আমি যেন একটা জাহাজের কর্ণধার, যে ভীষণ ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ে নোঙর ফেলতে পেরেছে।’

মাদ্রাজ পৌঁছানোর এক বছর পর বন্ধুকে লেখা এ চিঠি থেকে বুঝা যায়, মাথা গোঁজার মতো একটু ঠাঁই খুঁজে পেতে মধুসূদনকে কম কষ্ট করতে হয়নি। তিনি যখন নিজেকে বলেন ‘সজনহীন’ তখন বন্ধু এগবার্ট কেনেট পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনে হয় না। নিজেকে খ্রিষ্টান ও বিশপস কলেজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে শিক্ষক হয়েছিলেন। সেখানে কেনেটের যদি কোনো অবদান থাকে, তা নিতান্তই গৌণ।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ভাগে মধুসূদন যখন অ্যাসাইলাম স্কুলের শিক্ষক নিযুক্ত হন, তখন স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছেন সেখানকার একমাত্র শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক জে সি রে নেইলর। তার বিদায়ে শূন্যপদে অভিষিক্ত হন মধুসূদন। তবে মধুসূদনকে তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে নয়, নিয়োগ দিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বেতন নির্ধারিত হলো মাত্র ৪৬ টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয় বলে জানিয়েছেন মধুসূদনের জীবনীকারগণ। মধুসূদন নিজেই জানিয়েছেন ‘গরীব স্কুলের সামান্য একজন শিক্ষক।’ তারপরও সেই সময়ের তুলনায় এ বেতন একদম কম নয়। জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট হলেও মধুসূদনের মতো উদারহস্ত মানুষের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয়। বেতন সামান্য হলেও মধুসূদনকে চাকচিক্যময় ইউরোপীয় পোশাক পরতে হতো। মধুসূদন বলেছেন ‘তাকে একজন ট্যাঁশ ফিরিঙ্গি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।’ স্কুলের বিধি-বিধান সব কিছুই ছিল ইউরোপীয়। স্কুলের সব ছাত্র ইউরোপীয় ও ইস্ট-ইন্ডীয়। মধুসূদন একমাত্র বাঙালী, যিনি অ্যাসাইলাম স্কুলের শিক্ষক। স্কুল কর্তৃপক্ষ একজন কৃষ্ণকায় বাঙালীকে কেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন? ধারণা করি, জে সি রে নেইলরের বিদায় নেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ ভালো কোনো ইউরোপীয় শিক্ষক খুঁজে পাননি অথবা মাত্র ৪৬ টাকায় সব বিষয়ে পাঠদানযোগ্য মধুসূদনের মতো একজন পণ্ডিতকে হাতছাড়া করতে চাননি। মধুসূদনকে ঘিরেই আবর্তিত হতো স্কুলের পাঠসক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম।

জানা যায়, স্কুলে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত বাইবেল, ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ানোর জন্য একজনের বেশি শিক্ষক ছিলেন না। ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। পরবর্তী সময়ে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রীদের পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষিকা এবং ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে আর একজন শিক্ষিকাসহ এই অ্যাসাইলামের দুজন প্রাক্তন ছাত্রকে মধুসূদনের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচজন। সুরেশচন্দ্র মৈত্র তাঁর ’মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, অ্যাসাইলামে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা স্কুল ছিল। মধুসূদন মেল অ্যাসাইলামের শিক্ষক ছিলেন। এর পাশেই ছিল লেডিস ইনস্টিটিউট। মধুসূদনের প্রেমিকা, পরবর্তী সময়ে স্ত্রী রেবেকা ম্যাকটাভিস এই ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। গোলাম মুরশিদ তার ’আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন- বয়েজ স্কুল হলেও এই স্কুলে মেয়েদের পড়ানো হতো। ফিমেল অরফান অ্যাসাইলামের পরিচালকরা ভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিলেও ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের আগে মেয়েদের জন্য ভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়নি।

কী পড়ানো হতো অ্যাসাইলাম স্কুলে?


সেখানকার Routine of studies উদ্ধার করা হয়েছে ’আশার ছলনে ভুলি’ গ্রন্থে উদ্ধৃত রুটিনে দেখা যায় ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য দুটো শিফট ছিল। ছেলেদের শিফটে পাঁচটি ক্লাস। ছেলেদের প্রথম ক্লাসে পড়ানো হতো Scripture and Scripture History-Catechism With Scripture proofs- English Grammar- English History, Geography with especial reference to India– Use of the Globes- Writing and Arithmetic- Latin- Tamil and Teloogoo. দ্বিতীয় ক্লাসেScripture and Catechism with Scripture proofs- English Grammar-English History- Geography- Writing and Arithmetic-Tamil and Tiloogoo. তৃতীয় ক্লাসে Scripture- Geography and Grammar- Arithmetic- Reading and Spelling –Dictation-Writing.চতুর্থ ক্লাস. Reading and Spelling- Church Catechism-Writing on the Board-Arithmetic (viva voce) আর পঞ্চম ক্লাসে পড়ানো হতো Reading and Spelling-Catechism. ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্লাস কম। তাদের ছিল তিনটি ক্লাস। Female Orphan Asylum বিভাগে মেয়েদের প্রথম ক্লাসের Subject ছিল Scripture and Portions committed to Memory- Catechism with Scripture proofs- Scripture History and “Young Churchman Armed”- Grammar- Indian Geography- English and Roman History- Arithmetic- Writing. দ্বিতীয় ক্লাসে Scripture and Scripture Catechism and portions committed to Memory- “Young churchman Armed”- Grammar- Geography- Writing- Arithmetic Reading and Spelling. তৃতীয় ক্লাসে পড়ানো হতো Recitation of Scripture verses- Chureh Catechism with Scripture proofs “Young Churehman Armed”- Grammar- Geography- Writing- Arithmetic and Spelling.

১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের যে পাঠ্যক্রম আমরা পাই তা দেখে অবাক হই। ইংরেজি ভাষার এসব পাঠদান পণ্ডিত মধুসূদনের পক্ষে কঠিন কিছু ছিল না। কঠিন ছিল এতগুলো বিষয় পড়াতে সময়ে কুলিয়ে ওঠা। তারপরও সংবাদপত্রের জন্য লেখালেখি, প্রুফ দেখা এসবের পাশাপাশি মধুসূদনকে কত না পরিশ্রমই করতে হতো! স্কুলের পাঠদানের সময় ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছেলেদের। আর মেয়েদের পাঠদানের সময় ছিল দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এ স্কুলে ক্লাসের বাইরে নির্দিষ্ট ওয়ার্কসপে হাতেকলমে ছেলেদের বিভিন্ন কাজকর্ম শেখানো হতো। জুতো সেলাই-তৈরি থেকে চেয়ার-টেবিল তৈরির মতো সব কাজকর্ম শেখাতে হতো। আর মেয়েদের শিখতে হতো সেলাইয়ের কাজ। এসবের জন্য ছিল আলাদা প্রশিক্ষক। ইংরেজি সাহিত্য, ইংল্যান্ড-ইউরোপের ইতিহাস, ভূগোল, বানান শিক্ষা, ব্যাকরণ, তামিল-তেলেগু ভাষাসহ মধুসূদন বাইবেল পড়াতেন। আশ্চর্যের বিষয় বৈ-কি! নব্য খ্রিষ্টান মধুসূদন বাইবেলের শিক্ষক!
স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি মধুসূদন সাংবাদিকতা করতেন। মাদ্রাজে এসে প্রথমে তিনি ‘Madras Circulator’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এ পত্রিকাসহ মাদ্রাজের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কবিতা, প্রবন্ধ, উপসম্পাদকীয় লিখতে থাকেন। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাদ্রাজের সাপ্তাহিক ‘Eurasion’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। মাদ্রাজ সার্কুলেটর, এথেনিয়ামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় মধুসূদনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখালেখি দেখে এখানকার বিশিষ্ট সংবাদপত্রসেবী মি. অ্যাবলপেন সিমকিন্স মধুসূদনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাকে পত্রিকায় চাকরি দেন। ইউরেশিয়ান পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে মধুসূদনের কাব্য নাটক ‘Rezia: Empress of Inde’। তার আগে মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় মধুসূদনের প্রথম কাব্য ইংরেজি ভাষায় রচিত ‘The Captive Ladie’. একজন যোগ্য শিক্ষকের পাশাপাশি কবি ও সাংবাদিক হিসেবে এ সময়ে মধুসূদন মাদ্রাজের সুধী-সমাজে আলোচিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।


এ সময় হিন্দু ক্রনিকাল পত্রিকায় ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বৈরী আচরণের প্রতিবাদে উপসম্পাদকীয় ‘Mussalmans in India’ লিখে তিনি বিতর্কিত ও আলোচিত হন ব্যাপকভাবে। শুধু মুসলমান সম্প্রদায় নয়, মধুসূদন তার পত্রিকায় বিভিন্ন বর্ণ-বৈষম্যের প্রতিবাদে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখে সমাজে অবহেলিত, দলিত শ্রেণীর পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ সার্কুলেটর পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলামের পরিচালকরা তাদের স্কুলের জন্য বিলেত থেকে ইংরেজ শিক্ষক চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। মধুসূদনের মতো একজন ভালো শিক্ষক থাকতে কর্তৃপক্ষের কেন এই প্রচেষ্টা? না কি পত্র-পত্রিকায় ব্রিটিশদের প্রতি বিভিন্ন সমালোচনা, মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় তারা নাখোশ হয়েছিলেন? অসম্ভব কিছু নয়। আমরা দেখব, মধুসূদন ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পত্রিকায় শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনা করেছেন। ইউরোপীয় মহল দ্বারা পরিচালিত অরফ্যান অ্যাসাইলামে চাকরি করে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এটা কি করে হয়! এ ছাড়া এমনও হতে পারে, পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে তিনি শেষের দিকে স্কুলের দেখভালে মনোযোগী হতে পারছিলেন না। নতুন ইউরোপীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রতিবাদে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ এপ্রিল ‘ইউরেশিয়ান’ পত্রিকায় প্রতিবেদনে বলা হয়-
‘একজন ইউরেশিয়ান শিক্ষকের জায়গায় একজন ইউরোপিয়ান নিয়োগের ঔচিত্য সম্পর্কে আমি শুধু প্রশ্নই করছি না, আমি আপসহীনভাবে এর বিরোধিতা করছি। এ স্কুলটি হলো বিশেষ করে পূর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। তাহলে এই স্কুলের শিক্ষককে একজন ইউরোপিয়ান হতে হবে কেন? যারা চামড়ার রঙের পার্থক্যের কাছে নতি স্বীকারের শোচনীয় ক্রোধের আগুন জ্বালানো অব্যাহত রাখেন সেই অবলুণ্ঠিত মোসাহেবী এবং মানসিক দাসত্বের নিন্দা করার মতো কঠোর ভাষা আমাদের জানা নেই। ...এই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব যার ওপর অর্পিত রয়েছে, মননশীলতা, প্রতিভা এবং কর্মশক্তির দিক দিয়ে তিনি কোনো ইউরোপিয়ানদের তুলনায় ছোট নন।'

প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নাম ছিল না। এটা সম্পাদকীয় দফতর কর্তৃক লিপিবদ্ধ। তাই এটা যে মধুসূদনের নিজের কথা তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রতিবেদনে তিনি নিজেকে ইউরেশিয়ান বললেন কেন? তিনি তো ইউরেশিয়ান নন! তিনি বাঙালী, না কি খ্রিষ্টান বলে নিজেকে ইউরেশিয়ান ভেবেছেন? প্রতিবেদনের বক্তব্যে বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। মধুসূদন বৈষম্যের শিকার। অ্যাসাইলাম স্কুলে ইউরোপিয়ান ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ইউরেশিয়ান ছাত্রদের জন্য এটা ছিল নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সেখানে বোধ হয় বাঙালী শিক্ষক মধুসূদন তাদের মনঃতুষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য তাদের এই প্রচেষ্টা।

শিক্ষক হিসেবে মধুসূদন কেমন ছিলেন, সে বিষয়ে আমরা জানতে পারি। মাদ্রাজ স্কুলের বার্ষিক ফলাফল সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রশংসাসূচক মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ ‘Madras Christian Herald’ (মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান হ্যারল্ড) পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে ‘Very satisfactory’ বলা হয়। বলা হয়- ‘Must have been gratifying to the directors of the institution and to all who take and interest in this excellent charity..’ মধুসূদনের একক প্রচেষ্টা ও কর্মশক্তির জোরে অ্যাসাইলাম স্কুলের ফলাফল হয়ে ওঠে আলোচিত ও ঈর্ষণীয় । ‘Satisfactory’ এর সবটুকু মধুসূদনের।

অ্যাসাইলাম স্কুলের চাকরি থেকে অব্যহতি নিয়ে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তবে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি হতে পারেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুল বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণে তার সাংবাদিক জীবনের ছেদ পড়ে এ সময়। স্বাধীনচেতা সাংবাদিক মধুসূদন, শিক্ষক হিসেবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন কিনা, এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মধুসূদন চেষ্টা করেছিলেন সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতা একই সাথে চালিয়ে যেতে কিন্তু পারেননি। সাংবাদিকতা থেকে বিদায়ের খবরে বিখ্যাত ‘Athenaeum’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়-
‘দেশীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘Madras Hindu Chronicle’ই একমাত্র উঁচুমানের পত্রিকা। কিন্তু পত্রিকাটি এখন বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ পত্রিকার সুযোগ্য সম্পাদক মাইকেল ডাট পরিবেশের চাপে পড়ে মাদ্রাজ (বিশ্ববিদ্যালয়ের) স্কুলের চাকরি নিতে বাধ্য হচ্ছেন। স্কুল বোর্ড বলছে শিক্ষকতার সঙ্গে পত্রিকার কাজ করলে শিক্ষকতার ক্ষতি হবে। এটা ঠিক নয়। আসলে ক্ষতি হবে একটি দেশীয় পত্রিকার।’

আমরা জানি, মধুসূদন মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকাল পত্রিকা ছেড়ে আসার কয়েক মাসের মধ্যে এটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে মধুসূদন যে খ্যাতি সম্মানের আসনে ছিলেন, তার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ও সম্মান বেশি ছিল না। তার বেতন ছিল একশত পঞ্চাশ টাকা। আগের বেতন ৪৬ থেকে প্রায় সোয়া তিন গুণ বেশি। প্রথম শিক্ষক বা প্রথম টিউটর হলে পেতেন দুইশত পঞ্চাশ টাকা। আর কলেজের শিক্ষক বা ইন্সপেক্টর হলে বেতন হতো পাঁচশত টাকা। তবে মধুসূদন একটা বড় ধরনের আশা ও প্রত্যাশা বুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল তিনি ‘Captive Ladie’ এর মতো আলোচিত কাব্যের কবি, একটা উঁচুমানের সংবাদপত্রের সম্পাদক, নামজাদা সাংবাদিক। একটা ভালো জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে রাখবেন। কারণ এ রকম একটা প্রত্যাশার কথা কয়েক বছর আগে যিনি বন্ধুকে জানিয়েছিলেন। মাদ্রাজের এডভোকেট জেনারেল নর্টন ছিলেন তার বন্ধু। যার নামে তিনি তার প্রথম কাব্য ‘Captive Ladie’ উৎসর্গ করেছিলেন। নর্টনের প্রতি কবির প্রত্যাশা ছিল অনেক। তার কথা নিয়ে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধু গোরৗদাস বসাককে চিঠিতে জানিয়েছিলেন...

‘এ কথা শুনে তুমি বিস্মিত হবে, সত্যিই বিস্মিত হবে যে, এডভোকেট জেনারেল নর্টন লোক পাঠিয়ে আমাকে খবর দিয়েছেন। আমি আশা করেছিলাম, বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার অধিক সম্মান আমাকে দিয়েছেন এবং এখন যে কাজ করছি তার যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং আমার সমন্ধে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি জেনেছেন। আমার জন্য বর্তমান পদের চেয়ে অধিক সম্মানজনক ও আর্থিক সুবিধার কোনো সরাসরি কাজের জন্য চেষ্টা করবেন বলে কথাও দিয়েছেন। মনে হয় ঢাকা, বারানসী, হুগলী প্রভৃতি স্থানের মতো এখানে প্রিভিন্সিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। খুব সম্ভাবনা রয়েছে আমাকে প্রধান শিক্ষক বা ইন্সপেক্টরের পদ দেবার।’

প্রত্যাশা অনুযায়ী মধুসূদনের ভাগ্যে খুব সম্মানজনক পদ জোটেনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক। শিক্ষকতার পদটি সরকারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই যথাযথ সম্মানজনক না হলেও মধুসূদন ক্ষীণ আশার রশিটা ধরে রেখেছিলেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে শিক্ষকতার পদ জাতীয়করণ হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তিন বছর চাকরি করে তা তিনি ছেড়ে দেন অথবা তিনি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যে তার পদবি জাতীয়করণ হল।


জানি না তিনি কেন চাকরি ছেড়েছিলেন। হয়ত ঘরে স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও মাদ্রাজ স্কুলে তার সহকর্মী জজ হোয়াইটের কন্যা হেনরিয়েটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। এমনও হতে পারে স্কুলে কোনো বৈষম্যের প্রতিবাদে মধূসূদন চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্ণ বৈষম্য ছিল। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে এক নিম্নবর্ণের ছাত্র ভর্তি হলে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য শ্রীযুক্ত পিল্লে পদত্যাগ করেছিলেন। মাদ্রাজে এ ধরনের সমাজপতিদের পক্ষে মধুসূদনকে মেনে না নেওয়াই স্বাভাবিক। ৯

স্কুলের চাকরি ছেড়ে মধুসূদন আবার ফিরে আসেন সংবাদপত্র জগতে। ‘Madras Spectator’ দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে আগস্ট মাসে তিনি যোগদান করেন। স্কুলের চাকরি ছাড়ার পর চার মাস তাকে বেকার থাকতে হয়েছিল। মধুসূদন শিক্ষক হিসেবে সফল ছিলেন। তার ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইস্কুলের সবোর্চ্চ শ্রেণীতে সাহিত্য পড়াতেন তিনি। এ সময়ে একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘National vices and the means to rectify them’. এ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার এক অবাঙালী ছাত্রটি মথ্থুস্বামী আয়ার প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মথ্থুস্বামী স্কুল ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পান। যে চাকরির জন্য মধুসূদনকেও আমরা তদবির করতে দেখি। মথ্থুস্বামী পরবর্তীকালে হাইকোর্টের জর্জ হয়েছিলেন এবং ইংরেজ সরকার কর্তৃক ‘স্যার’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। জানা যায় মথ্থুস্বামী সারাজীবনে তার শিক্ষক মধুসূদনের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মধুসূদন মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। এ বছরেই তিনি হুগলী নর্মাল স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। যদিও শিক্ষকতার পদটি তিনি অর্জন করতে পারেননি।
শিক্ষকতা পেশায় মধুসূদন বরাবরই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

তথ্য নির্দেশ ও উল্লেখপঞ্জি :
১. জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন মধুসূদনের স্কুলের নাম ছিল ‘মাদ্রাজ মেল অরফান অ্যাসাইলাম।’ কিন্তু সে স্কুলের পূর্ণ নাম ছিল ‘মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলাম ফর দ্য চিলড্রেন অব ইউরোপিয়ানস এন্ড দেয়ার ডিসেনডানস।’ স্কুলের রুটিনে লেখা আছে, ‘মেল অরফান অ্যাসাইলাম এন্ড ফ্রি ডে স্কুল ফর বয়েজ।’ ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ মার্চ লেখা একটি চিঠিতে মধুসূদন তার বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন-‘আমি একটি গরীব স্কুলের সামান্য একজন শিক্ষক। যার নাম ‘মাদ্রাজ মেল অ্যাসাইলাম ফর দ্য চিলড্রেন অব ইউরোপিয়ানস অ্যান্ড দেয়ার ডিসেনডানস।’ (মধুসূদনের চিঠি-খসরু পারভেজ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ পৃষ্ঠা- ৩৬)
২. আশার ছলনে ভুলি-গোলাম মুরশিদ। আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ-১৯৯৭, পৃষ্ঠা-৯৫।
৩. মধুসূদনের চিঠি- অনুবাদ : খসরু পারভেজ । ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা; প্রথম সংস্করণ- ২০০৫, পৃষ্ঠা-৩৪।
৪. আশার ছলনে ভুলি-প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-১৩১।
৫. ‘ইউরেশিয়ান’ তারাই যাদের পিতা-মাতা দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন ইউরোপীয়, অন্যজন এশীয়।
৬. মাইকেল মধুসূদন দত্ত : জীবন ও সাহিত্য- সুরেশচন্দ্র মৈত্র। পুথিপত্র, কলকাতা -১৯৮৫।
৭. আশার ছলনে ভুলি- প্রাগুক্ত । পৃষ্ঠা-১৪০।
৮. মধুসূদনের চিঠি- প্রাগুক্ত । পৃষ্ঠা-৪০।
৯. মধুসূদন : বিচিত্র অনুষঙ্গ- খসরু পারভেজ। কথা প্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ- ২০১৩, পৃষ্ঠা-৭২।


খসরু পারভেজ : কবি ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত গবেষক।