আদুরীর ফিরে আসা
আদুরী নামের সেই মেয়েটি বেঁচে উঠেছে, আর দু-এক দিনের মধ্যেই আদুরী হাসপাতাল ছেড়ে যাবে। আদুরী ও তার মায়ের প্রশ্ন-এখন তারা যাবে কোথায়? খাবে কী? টেলিভিশনের সামনে তারা বলেছে ঢাকা ছেড়ে তারা নিজ গ্রামে চলে যাবে। সেখানে আদুরী স্কুলে ভর্তি হবে, লেখাপড়া শিখে সে হাসপাতলে কাজ করবে।
মাস খানেক আগে এক ময়লা কুড়োনী আদুরীকে আবিষ্কার করে একটি ডাস্টবিনে, যেখানে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়েছিল আদুরী। সেখান থেকে তুলে ময়লা কুড়োনী তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে। আদুরীর সারা গায়ে ছিল অত্যাচারের নানা চিহ্ন। তার গায়ে ছিল তাতানো ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাক দেওয়া দগদগে ঘা। আদুরীকে বাঁচানো যাবে এমনটি তখন হয়তো কেউ ভাবেনি। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে দ্রুতই সেরে উঠেছে আদুরী।
আদুরীকে উদ্ধারের পর বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমলে নেয়। যে বাসায় আদুরী কাজ করতো, সেই গৃহকত্রীকে আটক করে পুলিশ। ইতোমধ্যে গৃহকত্রীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে।
টেলিভিশনের সামনে আদুরী বলেছে, তার মা যদি ঢাকায় থাকে, তাহলে তাকে মেরে ফেলতে পারে। কারা মেরে ফেলতে পারে-তা অবশ্য সে বলেনি। তবে যারা তাকে অমানসিক অত্যাচার করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই কাজটি তারাই করতে পারে আদুরীর কথা থেকে আমাদের সেটাই ধরে নিতে হবে।
আদুরীর উপর যারা এই অত্যাচার করেছে আমাদের ধারণা আইনের কাছে তারা সাজা পাবে। আমাদের আরও বিশ্বাস আদুরী যদি গ্রামে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয় তাহলে সে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। সেদিনও হয়তো আদুরীকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হবে। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে আদুরীর আজকের জীবন-যুদ্ধের কথা।
আদুরীর এই কাহিনী যদি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হয় তাহলে ব্যক্তি আদুরীর বেঁচে যাওয়া এবং আগামীতে তার আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলেই সবকিছু সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু এতে যদি আমাদের গঠনোন্মুখ আধুনিক নাগরিক সমাজে অর্জিত একটি ব্যাধি হয় তাহলে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। যে গৃহকত্রী এই পাশবিক ঘটনাটি ঘটিয়েছে সে চরিত্রটি আমাদের মতো ভালো মানুষের মধ্যেও বলবৎ, যেকোনো সময় তা প্রকাশ পেতে পারে। তা যে শুধু কাজের মেয়ের ওপর নির্যাতনের চরিত্রে প্রকাশ পাবে তা নয়।
মানুষের সাথে মানুষের সাবেক সম্পর্ক আজ লোপ পেতে শুরু করেছে। চলছে আধুনিক পুঁজিবাদী নাগরিক সমাজের গঠন প্রক্রিয়া। যান্ত্রিক সভ্যতার অতি দ্রুত বিকাশে যে নাগরিক সমাজ গঠিত হচ্ছে, তা অনেক সময় হচ্ছে বিকলাঙ্গ। সমাজে বিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা প্রকট হচ্ছে কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে আইনের শাসন এগোতে পারছে না। এই জন্য শহরের বিচ্ছিন্ন বাসা-বাড়িতে যে মানবিক বৈকল্য তৈরি হচ্ছে, আইন দিয়ে তাকে মোকাবেলা করা হয়ে উঠেছে দুষ্কর। নানাভাবে তার প্রকাশ ঘটছে। আদুরীর উপর গৃহকত্রীর এই পাশবিকতা সেই মানসিক বৈকল্যেরই প্রকাশ। আমাদের উদ্দেশ্য গৃহকত্রীর দোষকে খাটো করে দেখা নয়, তবে এই গৃহকত্রী যে মানবিক গ্রামীণ সমাজ থেকে এসেছে সে কেন এই রকম একটি পাষণ্ডে পরিণত হল? সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের। শুধু কঠিন কঠিন আইন আর শাস্তি দিয়ে এই অবস্থার মোকাবেলা করা যাবে না।