দুর্ভাগা পোশাক শ্রমিকদের খণ্ডচিত্র
‘চাকরি হারাইয়া অনেকে শরীরের ব্যবসা করতাছে’
‘চাকরি হারাইয়া অনেকে শরীরের ব্যবসা করতাছে। আমরা তো তা করি না; এই কারণে আমাগো কষ্ট বেশি।’
কথা হচ্ছিল রাজধানীর মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজের পাশে অবস্থিত ইয়াং তুং কারখানার শ্রমিক রোখছানার সঙ্গে।
আপা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতাম- প্রতিবেদকের এমন কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে কিছু দূর হেঁটে গিয়ে আবার পেছনে ফেরেন রোখছানা, সঙ্গে আরও কয়েকজন।
-আপা আমি সাংবাদিক।
-কি কথা কন?
-আপনাদের দিনকাল কেমন চলছে এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করব, তাই…।
-এই কথা আপনারে কইয়া কোনো লাভ আছে? আমাগো অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে।
-তাও যদি একটু বলতেন…।
-সকাল ৮ থেক্কা রাইত দশটা পর্যন্ত ডিউটি করি, কারখানায় কাজের লোড থাকলে কোনো কোনো সময় সারা রাইত থাকতে হয়।
-তাহলে তো ওভারটাইম পান…।
-সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতন পাই। তাও ঠিকমতো পাই না। আবার ওভারটাইম?
-কেন সরকার তো সময়মতো বেতন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে…।
-কারখানার মালিকরাই তো সরকার। হেরা যখন তখন ছাঁটাই করে, মাসের পর মাস আমাগোরে বেতন না দিয়া থাকতে পারে।
-বলেন কি? বেতন দেয় না, কোনো কারণ ছাড়াই ছাঁটাই করে?
-ছাঁটাই করতে আবার কারণ লাগে? যখন হেগো ইচ্ছা তখনই ছাঁটাই করে। আর বেতনের কথা কইতাছেন, গত তিন মাস হইলো বেতন পাই না। মালিকে কয় হরতাল-অবরোধের কারণে আয় নাই। বেতন না পাইয়া অনেকেই চাকরি ছাইড়া শরীরের ব্যবসায় নামছে। আমরা তো তা করি না এই কারণে আমাগো কষ্ট বেশি।’ -কিসের কষ্ট…।
-কত ধরনের কষ্ট। সবটা আপনারে কইতে পারুম না। ছোটকালে বাপ-মারে হারাইছি। ভাইয়ের সংসারে মানুষ হইছি। অল্প বয়সে বিয়া অয়। বিয়ার কিছুদিন বাদে স্বামী আমারে ছাইড়া চইলে গেলে ঢাকায় আইসা গার্মেন্টসে কাম লই। রক্ত ঘামের পয়সা দিয়া সংসার চালাই। গত কয়েক মাস এক বেলা খাই তো আরেক বেলা খাই না।
- খান না কেন?
-খাবার পাব কই। নিজে না খাইলেও বাচ্চাটার জন্য বড় কষ্ট লাগে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় সব ছাইড়া দিয়ে অন্যগোর মতো শরীরের কাম করি। কিন্তু পরে আবার ফিরা আসি।
-টাকাই তো সব না।
-কিন্তু দেখেন না টাকার জন্য রাজনীতিবিদরা কত কিছুই না করতেছে।
-হেরা তো মানুষ না। মানুষ অইলে তো এতগুলো মানুষকে পুড়াইয়া মারত না।
-তা হলে ভোট দিতে যান নি…।
-ভোট আবার কি? আমরা পেটপূজা করি। আমাগো ভোটে কি কিছু যায় আসে? গতবারও তো ভোট দিলাম। কিছুই পাইলাম না। আমাগো অবস্থা আগের মতোই রইয়া গেছে।
-ছেলেরে নিয়ে কিছু ভাবছেন।
-হে রে ভাই। ওরে লইয়াই তো সব ভাবনা। ওর বন্ধুগোরে নেতারা ৫০ টাকা দিয়া ককটেল মারতে পাঠায়। আমি তো হারাদিন গার্মেন্টসে থাকি। কবে যে আমার পোলাটা ওই সঙ্গে যায়। এই তো হেদিন আমাগো বস্তির এক পোলা ককটেল মারতে গিয়া পুলিশের হাতে ধরা খাইছে। পরে ওরে মার্ডার কেসের আসামি কইরা পুলিশ থানায় চালান কইরা দিছে। আপনার লগে মেলা কথা কইছি। অহন লাঞ্চে যাইতে হবে। পরে ঢুকতে দেরি হইলে বেতন কাটবে সুপারভাইজারে।
পোশাক শ্রমিকদের জীবনযাপনের বিষয়টি তুলে আনতে সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন গার্মেন্টসে ঘুরে বিচিত্র সব তথ্য মিলেছে। এমনই একটি জায়গা মালিবাগের ফাইভ স্টার গার্মেন্টস। গার্মেন্টসটির সামনে জটলা দেখে ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, একটি মেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। কী হয়েছে জানতে চাইলে মধ্যবয়সী এক নারী বলেন, কি হয়েছে সেটা আপনার কাছে বলে কী লাভ? আপনি কে?
-আমার ব্যাগে পানি আছে; ওনার চোখে-মুখে পানি দেন? হয়ত ঠিক হয়ে যাবে।
এই কথায় আশ্বস্ত হয়ে পানি দিয়ে দেখে একটু পরে ঠিক হয়ে গেছে। তারপর উপস্থিত জনতা বাহবা দেওয়ার আগেই জানতে চাই- ওনার কি হয়েছে?
মধ্যবয়সী নারীর এবার সবিনয় উত্তর, মাইয়াটা পোয়াতি? শরীর খারাপের জন্য গার্মেন্টসে দুই দিন না আসতে পারায় ওরে গার্মেন্টস থেকে বাইর কইরা দিছে?
-কেন?
-কেন আবার, আমাগো গার্মেন্টসের সুপারভাইজার বিয়া করব এইডা বইলা মাইয়াডারে ভোগ করছে, পোয়াতি বানাইছে। অহন বিয়া করতে অইব এই ডরে হেরে চাকরি থেইক্কা বাদ দিয়া দিছে।’
-তার অপরাধ…
-ওর অপরাধ ও মাইয়া মানুষ। দুনিয়ার দুই কূলে ওর কেউ নাই। আমার লগে থাকে। অহন এই অসুস্থ শরীর লইয়া মাইয়াটা কি খাইব, কই যাইব, হায়রে সমাজ। গরিবের লাইগা কিচ্ছু নাই।
‘সমাজের গুষ্টি কিলাই।’-হঠাৎ এক তরুণীর আগমন।
-খালা ওরে ধইরা রিকশায় তোলেন। বাসায় নিয়ে ডাক্তার দেখাইয়েন, এই লন এক হাজার টাকা। অসুস্থ মেয়েটিকে রিকশায় তুলে দিয়ে রাস্তার পাশে চা দোকানে বসে ক্ষিপ্ত তরুণীটি।
চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে এ প্রতিবেদকের প্রশ্ন -আপা আপনি দেখি সমাজের ওপর ক্ষিপ্ত…।
-গুল্লি মারি সমাজেরে। আমি সুন্দর কইরা বাচঁতে চাইছিলাম। এই সমাজ আমারে বাচঁতে দেয়নি।
-মানে?
-অনেক আশা কইরা গার্মেন্টসে চাকরি লইছিলাম, কিন্তু হেরা আমারে টিকতে দেয়নি।
-কারা…।
-কারা আবার গার্মেন্টসের ওই জানোয়ারগুলা। আমারে পদে পদে শারীরিক নির্যাতন করছে। তারপর বেতনও দিত কম।
-তারপর…।
-তারপর সব ছাইড়া ছুইড়া দিয়া পতিতার কামে নামছি।’
-কেন?
-কেন আবার। হেরা আমার বেতন দিত ৪ হাজার টাকা। তাও আবার অনিয়মিত। ওভারটাইম করাইয়া টাকা দিত না। তার ওপর শারীরিক নির্যাতন। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, ইজ্জত যখন হারাইছি তখন আর এটার চিন্তা কইরা লাভ নাই। মালিবাগ থেক্কাই রামপুরায় আমার আন্ডারে ১৫ জন মাইয়া কাম করে। টাকা যা পাই সবাই ভাগ কইরা লই। অহন আমার হাতে টাকা থাকলেও প্রিয় জিনিসটি নাই।
-কি…?
-আমার পোলাটা। বুঝ হইবার পর আমার সব কিছু জাইনা ও আমারে ছাইড়া চইলা গেছে। অথচ ওরে বাঁচাইবার লাইগা, ওর মুখে চাইরটা ভাত তুইলা দিতে এই লাইনে আইছি। অথচ ও আমার দুঃখ বুঝল না। হায়রে কপাল। আইচ্ছা আপনি কে, কি কাম করেন।
-আমি একজন সংবাদকর্মী।
-ও সমবাদিক। এর লাইগা খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া অত কথা জিগাইতেছেন। আর আমিও সব কইয়া দিলাম। অহন তো আপনি পুলিশের কাছে যাইয়া সব কইয়া দিবেন।
-নারে ভাই; কারও কাছে কিছু বলব না। কাজের খাতিরে আপনার লগে আলাপ…
-আপনাগো বিশ্বাস নাই।
নিজের ভেতরে এক ধরনের তীব্র হাহাকার অনুভব করে সেই স্থান ছেড়ে আবার মিশে গেলাম গণমানুষের সঙ্গে। ততক্ষণে ছুটি দিয়েছে অনেক গার্মেন্টস। পোশাক শ্রমিকদের ভিড়ে নিজেকে যুক্ত করলাম, হাঁটতে হাঁটতে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম তাদের কথা।
‘হালারা এই মাসে বেতনটা দিতে দেরি করতাছে। কেমনে পোলাটার স্কুলের বেতন দিমু। বাসাভাড়া দিমু। গার্মেন্টসের কাম না থাকায় শুনছি অনেকেরে বাদ দিয়ে দিতাছে। কি যে করুম কিচ্ছু বুছতাছি না।’
পুরুষ মানুষের এই কথার উত্তরে হাঁটতে থাকা এক নারী বলে উঠল, ‘চিন্তা কইরো না। আল্লা ভরসা সব ঠিক হইয়া যাইব। দেইখো একটা না একটা ব্যবস্থা হইব।’
এই কথা বলতে বলতে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল তারা। আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা হল না…
(দ্য রিপোর্ট/এএইচ/এসবি/ এনআই/এইচএসএম/জানুয়ারি ২৫, ২০১৪)