কাওসার আজম ও মীর মো. ফারুক, বিশ্ব ইজতেমা ময়দান থেকে : বিশ্ব মুসলিমের সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনায় রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাতের দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয় আখেরি মোনাজাত। শেষ হয় ১টা ১৬ মিনিটে। ৩০ লাখেরও বেশি দেশি-বিদেশি ধর্মপ্রাণ মুসল্লির অংশগ্রহণে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারতের মাওলানা জোবায়রুল হাসান। এ সময় পুরো টঙ্গী এলাকা ধর্মপ্রাণ ত্রিশ লাখ মুসল্লির আমিন আমিন ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়।

১৬০ একর ইজতেমা ময়দান পেরিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, আশপাশের রাস্তাসহ কয়েক কিলোমিটারজুড়ে মানুষের ঢল নামে। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আবার অনেকে বাসাবাড়ির ছাদে শামিয়ানা টানিয়ে মোনাজাতে শরিক হন। বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মোনাজাতে শরিক হন এবং আমিন আমিন ধ্বনি তোলেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বঙ্গভবন থেকে তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে শরীক হন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের দরবার হলে কর্মকর্তা ও স্টাফদের সঙ্গে টঙ্গী থেকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত মোনাজাতে অংশ নেন।

প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আশরাফুন্নেসা মোশাররফ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যগণ মোনাজাতে অংশ নেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টঙ্গীতে এটলাস বাংলাদেশের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। এ ছাড়াও ১৩ নম্বর গেট এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি। চারদিন বিরতি দিয়ে আগামী ৩১ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে। ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।

আখেরি মোনাজাতের আগে সকাল ১০টা থেকে চলে হেদায়েতি বয়ান। হেদায়েতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা-দ। বয়ানে তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘হেঁটে বেশি মানুষকে দীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধুলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেবে।’

শীত উপেক্ষা করে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় জমায়েত হন। শুক্রবার বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা। চলে জিকির-আসকার। প্রথম পর্বের ইজতেমায় বয়স ও শীতজনিত কারণে একজন ইয়েমেনি নাগরিকসহ মোট নয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ : বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুজর্গরা বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনানো হয়। বিদেশি মেহমানরা মূল বয়ান মঞ্চের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাশে হোগলা পাটিতে বসেন। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনান।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। এর মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রায় ১২ হাজারের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। ইজতেমাস্থলে নিরাপত্তা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে বেশ কয়েকটি সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসানো হয়। র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ওই সব টাওয়ার থেকে ইজতেমাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরায় ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আকাশে হেলিকপ্টারে ও তুরাগ নদীতে স্পিডবোটের টহলও জোরদার ছিল।

২২ হাজার বিদেশি মুসল্লি : এবারের বিশ্ব ইজতেমায় ভারত, পাকিস্তান, মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনেগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাঞ্জেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুয়ে, বেলজিয়াম, ক্যামেরুন, চীন, কমোরেস, ফিজি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, কোরিয়া, আলজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, জর্ডান, মৌরিতানিয়া, সুদান, দুবাইসহ বিশ্বের ১২৫টি রাষ্ট্রের ২২ হাজার মুসল্লি অংশ নেন বলে নিশ্চিত করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।

যান ও জনজট : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মুসল্লিরা শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় অসহনীয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারও হেঁটে রওনা দেন মুসল্লিরা। আর হাঁটা মুসল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন ইজতেমা মাঠের আশপাশের এলাকায় থেমে যায়।

২০১৪ সালের দুই পর্বের ইজতেমার প্রথম পর্বে শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এএস/এমডি/শাহ/জানুয়ারি ২৬, ২০১৪)