ট্রাফিক আইন অমান্য
দৈনিক দেড় হাজার মামলা, জরিমানা ৬ লাখ টাকা
রাজধানীতে শুধু ট্রাফিক আইন ভঙ্গের দায়ে দৈনিক গড়ে দেড় হাজারের অধিক মামলা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। একই সঙ্গে আইন অমান্যের দায়ে জরিমানা বাবদ দৈনিক গড়ে আদায় ছয় লক্ষাধিক টাকা।
এদিকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অবগত না থাকা এবং আইন জানা সত্ত্বেও আইন মানতে গাফিলতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন অনেকেই। আর ট্রাফিক আইন অমান্যকে যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
রাজধানীর কারওয়ানবাজার-পান্থপথ মোড়, ফার্মগেট মোড়, বিজয় সরণি মোড়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সব ধরনের বাস, মিনিবাস, ট্রাক থামানো ও যাত্রী ওঠা-নামা করানো নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড রাখা আছে। কিন্তু তা মানছে না গণপরিবহনের চালকরা। অধিকাংশ সময় এ সব পয়েন্টে দীর্ঘ সময় যত্রতত্রভাবে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করতে দেখা যায়। আর এতে করে এ সব পয়েন্টে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও আইনের প্রয়োগ খুবই কম দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ না হওয়া এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবগত ও সচেতন না করার জন্য এ ধরনের আইন অমান্যের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১১ সালে ট্রাফিক আইন অমান্যের দায়ে ছয় লাখ ৬৩ হাজার ৬১০টি মামলা হয়েছে। এ সব মামলার মধ্যে আমলযোগ্য মামলা রয়েছে ছয় লাখ ২৮ হাজার ২২টি এবং আমল অযোগ্য মামলার সংখ্যা ৩৫ হাজার ৫৪টি। একই বছরে ট্রাফিক আইন অমান্য করার দায়ে মোট ২৫ কোটি ৬৭ লাখ সাত হাজার ৯৫৫ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে মামলা করা হয় ছয় লাখ ৫৫ হাজার ২৮২টি, জরিমানা করা হয় ২৭ কোটি ৪৯ লাখ ৬১ হাজার ২৫০ টাকা, ২০০৯ সালে মামলা হয় চার লাখ ৮২ হাজার ২৬১টি এবং জারিমানা আদায় করা হয় ২০ কোটি ৮৭ লাখ ৫৯ হাজার ৮০০ টাকা। গড়ে প্রতিদিন ট্রাফিক আইন অমান্যের দায়ে মামলা হচ্ছে এক হাজার ৫৮১টি এবং জরিমানা আদায় করা হচ্ছে ছয় লাখ আট হাজার টাকার অধিক।
রাজধানীতে আশঙ্কাজনকহারে ট্রাফিক আইন অমান্যের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপি ট্রাফিকের পূর্ব অঞ্চলের উপ-কমিশনার ইকবাল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আগের বছরের তুলনায় বর্তমানে আইনের প্রয়োগ বেশি হওয়ায় মামলা ও জরিমানা আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘মামলা বেশি হওয়া মানে জনগণ আইন সম্পর্কে সচেতন নয় এমনটি নয়। আগের তুলনায় মানুষ এখন ট্রাফিক আইন সম্পর্কে বেশি সচেতন। কিন্তু প্রতিনিয়ত রাজধানীতে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ট্রাফিক কনজেশন বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজধানীর সড়কসমূহের প্রকৌশলগত ত্রুটি থাকায় অনেক ক্ষেত্রে গণপরিবহনগুলো যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করায়। আর এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ট্রাফিক পুলিশও বিষয়টি আইন অমান্য হিসেবে গণ্য করে মামলা করছেন।’
অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রভাবশালীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের প্রবণতা বেশি। আর এই অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক ও স্বয়ং পুলিশ বাহিনী। এ ছাড়া যে যেভাবে পারছে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভাঙছেন ট্রাফিক আইন।
এদিকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত সিগন্যাল বাতিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের হওয়ায় অনেক সময় সেগুলো কাজে আসছে না। বৈদ্যুতিক গোলোযোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে বাতিগুলো অকেজো হয়ে পড়লে তার মেরামতে নেওয়া হয় দীর্ঘ সময়। ফলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রাফিকিং ব্যবস্থা চালিয়ে নিতে হচ্ছে পুলিশকে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের পশ্চিম অঞ্চলের কর্তব্যরত সার্জেন্ট সমরেশ রাজধানীর সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যারা আইনের লোক এবং আইন নিয়ে কথা বলেন তারাই ট্রাফিক আইন বেশি ভাঙছেন। রাজধানীতে যারা ফুটপাথ ও বিপরীত দিক দিয়ে মোটরসাইকেল চালান তাদের অধিকাংশই হয় পুলিশ না হয় সাংবাদিক। সাধারণ জনগণ সাহস দেখায় না ট্রাফিক আইন অমান্য করার।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সময় আইন অনুযায়ীও আমরা দায়িত্ব পালন করতে পারি না। ট্রাফিক সিগন্যাল বা ট্রাফিক আইন অমান্য করলে যখন কোনো প্রাইভেট কার আমরা আটক করি, তখন দেখা যায় ভেতরে বসা কোনো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাদের ধমকাতে শুরু করেছেন- ‘আমাকে চিনিস, আমি কে’, ‘তোকে দেখে নিবো…’ এ ধরনের হুমকি দেন তারা। অনেক সময় তারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ফোন দেন। আর তখন তাদেরও বকাবকি শুনতে হয় আমাদের।’
সমরেশ বলেন, ‘আমি আপনাকে নাম বলবো না, কিছু দিন আগে বিজয় সরণি সিগন্যাল পয়েন্টে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হই আমি। সংসদ ভবন এলাকা থেকে একটা প্রাইভেট কার দ্রুত গতিতে বিজয় সরণির দিকে আসছিল, তখন ওই পয়েন্টটিতে সিগন্যাল চলছিল। কিন্তু সেই সিগন্যাল না মেনে প্রাইভেট কারটি সোজা তেজগাঁও ফ্লাইওভারের দিকে যেতে থাকে। সেখানে আমাদের দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ গাড়িটির গতিরোধ করে। গাড়িটির গতিরোধ করায় গাড়ির চালক বেরিয়ে এসে ওই ট্রাফিক পুলিশের উপর চড়াও হন। তখন আমি বিষয়টি দেখতে পেয়ে দ্রুত সেখানে ছুটে যাই। আমাকে দেখে তিনি আরও বেশি চড়াও হন। বলতে শুরু করেন, ‘আমাকে চিনিস আমি ওমুক এমপি’র ভাই। তোকে দেখে নিবো, আমার গাড়ি থামাস।’ এরপর শুরু হল এখানে সেখানে ফোন দেওয়া। উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দেন। এভাবেই দায়িত্ব পালনে চাপের মধ্যে থাকতে হয় আমাদের।’
রাজধানীতে প্রাইভেট কার এবং মোটরসাইকেল চালকেরা বেশি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেন বলে জানান এই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের পশ্চিম অঞ্চলের আরেক ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. নূরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রাইভেট কার চালকেরা অধিকাংশ সময় ট্রাফিক সিগন্যাল মানেন না। রাস্তার পাশে যেখানে সেখানে পার্কিং করে রাখে। গাড়ি চালানোর সময় সিট বেল্টও বাঁধে না তারা। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালায়। আর এ সবের বিরুদ্ধে আমরা যদি কোনো অ্যাকশন নিতে যাই তাহলে শুরু হয় বিপত্তি। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মোটরসাইকেল আরোহীদের। তারা দেখা যায় এক হাতে মোটরসাইকেল ড্রাইভ করছেন অন্য হাতে মোবাইল ফোন। অনেকেই আবার হেলমেট ব্যবহার করেন না। আর সুযোগ পেলে বিপরীত রাস্তায় বা ফুটপাথ দিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না।’
নূরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে এগুলো আমরা দেখেও কিছু বলি না। কারণ আমাদের জনবল খুবই কম। এই জনবল নিয়ে ঢাকা শহরে এখনো ট্রাফিক ব্যবস্থা টিকে রয়েছে এটাই আশ্চর্যের বিষয়। দেখা গেল একটা প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল আটক করলাম ঠিক তখন কয়েক শ’ গাড়ি বিশৃঙ্খলা শুরু করে দিল। তাই অনেক সময় এগুলো দেখেও কিছুই করার থাকে না আমাদের।’
গণপরিবহনগুলোর ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা কম থাকলেও যাত্রীরা সচেতন না বলে মনে করছেন এই দুই কর্মকর্তা।
তাদের মতে, ‘যখন একটা বাস ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে, তখন ওই বাসের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে যাত্রীরা আমাদের ওপর তেড়ে আসেন। অনেক যাত্রী নিজের ক্ষমতার ভয়ও দেখান। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন তারা অকথ্য ভাষায় কথা বলেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ধান্দাবাজি শুরু হয়েছে’, কেউ বলেন, ‘ঘুষ খাওয়ার জন্য আটকেছে’, ‘এক শ’ টাকা গুঁজে দেন কোমরে দেখবেন ছেড়ে দিয়েছে ইত্যাদি।’
পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা বলেন, ‘যাত্রীরা আমাদের সঙ্গে অসদাচরণ করলেও বাসচালক যে আইন অমান্য করেছে সে বিষয়ে তাদের কোনো প্রতিবাদ নেই। বরং সিগন্যালে অনেকক্ষণ আটকা পড়লে যাত্রীরা বাসচালককে উল্টা পথে যাওয়ার জন্যও উৎসাহিত করে।’
অন্যদিকে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতির কারণ হিসেবে রাজধানী কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, দেশের উচ্চ আদালত, সচিবালয়, ব্যাংক, বীমার প্রধান কার্যালয় ও ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গার্মেন্টস এবং অন্যান্য শিল্প কারখানার জন্য বাড়ছে রাজধানীমুখী মানুষের সংখ্যা। রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তুলনামূলক বাড়ছে না রাস্তা ও গণপরিবহনের সংখ্যা। অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে প্রাইভেট গাড়ি ও রিক্সা।
এ ব্যাপারে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশের ন্যাশনাল অ্যাডভোকেসির কর্মকর্তা ও পরিবহন বিষয়ক গবেষক মারুফ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আদর্শিক নগরের প্রধান বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, একটি শহরের আয়তনের কমপক্ষে ২০ শতাংশ সড়ক থাকতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঢাকার নগর পরিকল্পনায় এ ধরনের কোনো নির্ধারিত বিষয় নেই। শহরের প্রকৃতি অনুযায়ী এবং ব্যবহৃত ট্রাফিক মডের (যানবাহন) ওপর নির্ভর করবে কত শতাংশ সড়ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়, সীমানা ও জনঘনত্ব পর্যন্ত একটি শহরকে বাড়তে দেওয়া উচিত। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই।’
মারুফ বলেন, ‘রাজধানীতে যতটুকু সড়ক রয়েছে তারও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বড় ও আরামদায়ক গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারছে না সরকার। ফলে উচ্চবিত্তদের মধ্যে প্রাইভেট কার ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’
ট্রাফিক ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে ঢাকার যানজট নিরসনে স্থায়ী সমাধান হবে না বলে মনে করছেন নগর ও পরিবহন পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গোলাম মর্তুজা। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয়) ট্রাফিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা কখনোই যানজট নিরসনের স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। কিংবা রাজধানীর ট্রাফিক বিভাগ যেসব কার্যক্রম সম্পন্ন করছে সেগুলোও আশানুরূপ ফল দিবে না।’
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘রাজধানীর যতটুকুই সড়ক আছে তা দিয়ে একে একটি যানজটমুক্ত শহরে পরিণত করা সম্ভব। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে প্রাইভেট কার প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা দরকার। তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে সাধারণের জন্য অনুকূল গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং মাস র্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) ব্যবস্থা করতে হবে।’
(দ্য রিপোর্ট/ এইচআর/ এইচএসএম/ এনআই/জানুয়ারি ২৬, ২০১৪)