৬ মাসের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কর্মপরিকল্পনা
রানা মুহম্মদ মাসুদ, দিরিপোর্ট ২৪ : পেশাগত স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা’র আলোকে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে সরকার। এছাড়া পেশাগত ব্যধি শনাক্তকরণে বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২১ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা’ অনুমোদন দেওয়া হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘আমাদের দেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে শিল্প ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কর্মস্থলে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেশে কোন নীতিমালা নেই।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার দিরিপোর্ট২৪কে বলেন, ‘দেশে এই প্রথম কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন এই নীতিমালার আওতায় আগামী ৬ মাসের মধ্যে আমরা একটি ওয়ার্ক প্ল্যান করবো। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়বে ও বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হবে।’
প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতভুক্ত শিল্প, কারখানা, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিখাত, কৃষিভিত্তিক খামার ও অন্যান্য সকল কর্মস্থল আওতাভুক্ত করা হয়েছে নীতিমালায়। এ নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে কর্মপরিবেশের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন, যার মাধ্যমে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মৃত্যু, জখম হওয়া বা রোগ ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়া ক্রমাগতভাবে কমবে।
নীতিমালায় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্টেক হোল্ডার হিসেবে সরকার, মালিক সংগঠনের/সমিতির, ট্রেড ইউনিয়নের, নিয়োগ কর্তা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়িত্ব ও ভূমিকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
সরকারের ভূমিকার মধ্যে রয়েছে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি ঝুঁকি এবং ঝুঁকিপূর্ণ অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করা, এ বিষয়ে জাতীয় প্রোফাইল তৈরি করা, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং এমন অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষা করা। কর্মস্থালে নারী বিশেষ করে সন্তান সম্ভবা নারী শ্রমিকদের বিশেষ স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং এ বিষয়ে গবেষণা, জরিপ পরিচালনা করা।
পেশাগত ব্যধি শনাক্ত করতে বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি এবং তাদের পেশাগত দক্ষতা যুগোপযোগী করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান। দুর্ঘটনার পর শ্রমিকের চিকিৎসা সেবা ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের কর্মক্ষমতা অনুযায়ী তাকে কর্মক্ষেত্রে পুনর্বাসন করা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় মান নির্ধারণ করা, এ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর মওকুফের বিষয় বিবেচনা করা। দেশের বিভিন্ন শ্রমঘন এলাকায় শ্রম আদালত স্থাপন। প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা। সরকারি বড় হাসপাতালগুলেতে পেশাগত ব্যধি এবং পেশাগত স্বাস্থ্য সমস্যা বিষয়ে আলাদা ইউনিট স্থাপন করা। পেশাগত ব্যধি শনাক্ত করতে অক্যুপেশনাল হেলথ সার্ভিলেন্স কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা।
নীতিমালায় মালিক সংগঠনের ১৩টি দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, মলিক সংগঠনসমূহে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি ইউনিট বা সেল গড়ে তোলা। কর্মস্থলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি শনাক্ত করতে নির্দিষ্ট সময় পর পর শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। শ্রম ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনের বিধান বাস্তবায়নে মালিকদের উৎসাহিত করা। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ পেতে সহযোগীতা করা।
ট্রেড ইউনিয়নের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মস্থলের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা ও শ্রমিকদের অবহিত করা। নীতিমালায় উল্লেখ করা ট্রেড ইউনিয়নের সাতটি দায়িত্বের মধ্যে আরো রয়েছে, ইউনিয়নের সদস্যদের আইন মেনে চলতে উদ্ধুদ্ধ করা, সহযোগিতা প্রদান, প্রতি ট্রেড ইউনিয়নে সেইফটি ইউনিট গড়ে তোলা, নীতিমালা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
নিয়োগকর্তার ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ভূমিকার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে কারখানা নির্মাণে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করা, পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে আগেই অবহিত করা। কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক ও অন্যান্য পদার্থ পরিবহন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নিশ্চিত করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা।
বাস্তবায়ন কৌশল : নীতিমালা অনুযায়ী স্টেক হোল্ডারদের সহযোগীতায় এ নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের। এ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ফোকাল পয়েন্ট করে সরকারি ও বেসরকারি সকল স্টেকহোল্ডারদের যুক্ত করে সমন্বিতভাবে এ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবে। এ নীতিমালা অনুমোদনের ছয় মাসের মধ্যে সরকার নীতিমালার লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে। জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য মালিক সংগঠন তাদের বার্ষিক কর্মসূচি সরকারের কাছে দাখিল করবে। সকল স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে (উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ) আলোচনার ভিত্তিতে মালিক, শ্রমিক সংগঠনের কার্যক্রম সমন্বয় করে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল কমিটি এ কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিশ্চিতে তদারকি করবে। জাতীয় কর্মপরিকল্পনাভুক্ত সরকারের কর্মকাণ্ড, মালিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বার্ষিক প্রতিবেদন সরকার নিয়মিতভাবে প্রকাশ করবে। স্টেক হোল্ডারদের কাজের নিয়মিত পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি ছোট আকারের স্থায়ী টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হবে বলেও নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
(দিরিপোর্ট২৪/আরএমএম/এমসি/জেএম/নভেম্বর ০২, ২০১৩)