সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিতুমীর নামেই বেশি পরিচিত। জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে তার নির্মিত দুর্গ বাঁশের কেল্লা এ অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের যুগে যুগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
মীর হাসান আলী ও আবেদা রোকাইয়া খাতুন দম্পতির চার সন্তানের একজন তিতুমীর। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে এ অঞ্চলে আসেন।
তিতুমীরের পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। গ্রামের ওস্তাদের কাছে উর্দু, আরবি, ফারসি, বাংলা ও ধারাপাত শেখেন। পড়াশোনার পাশাপাশি মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোড়া ও তলোয়ার চালনায় পারদর্শিতা অর্জন করেন।
১৮০১ সালে কুরআনে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেই সঙ্গে বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন। এর আগে ও পরে তিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। ১৮০৮-১৮১০ সালের দিকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা শহরে যান। সেখানেও কুস্তি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। কুস্তি লড়াইয়ে প্রথম হলে কলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার নজরে পড়েন। তার সাহায্যে সামরিক কৌশল আয়ত্ব করেন।
কর্মজীবন শুরুর আগেই তিতুমীর চব্বিশ পরগণার বাদুড়িয়ার খালপুর গ্রামের হযরত শাহ সূফী মুহম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে মায়মূনা খাতুনকে বিয়ে করেন।
১৮২২ সালে হজ পালন করেন। সে সময় তার চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। মক্কায় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তিতুমীরকে নিয়ে তার পীর হযরত সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর কাছে যান। ধর্ম সংস্কারক ব্রেলভী ছিলেন উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তিতুমীর তার মুরিদ হন। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে মিসর, পারস্য, আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক স্থান ও পীর-আলেমদের কবর জিয়ারত শেষে ভারতবর্ষে ফেরেন।
ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত তিতুমীর ১৮২৭ সালে গ্রামে ফিরে শিরক ও বিদাতমুক্ত সমাজ গঠনের দাওয়াতে নেমে পড়েন। মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায়ও মনোযোগ দেন। অল্প দিনেই তিন-চারশ’ শিষ্য সংগ্রহ করেন৷ দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তারা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহ্বান্দ’ নামে এক ধরনের কাপড় পরা শুরু করেন। ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াত শান্তিপূর্ণভাবে চলে।
তার সাফল্যে হিন্দু জমিদাররা ভয় পেয়ে যায়৷ এরপর শুরু হয় ওয়াহাবীদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার। এমনকি দাড়ি, মসজিদ নির্মাণ, নাম পরিবর্তনের ওপর খাজনা আদায় শুরু হয়। এসব কারণে তিতুমীরের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়। স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে জয়লাভ করেন তারা৷ তার নির্দেশে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
এরপর বারাসাতে সরকারের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। চব্বিশ পরগণার কিছু অংশ, নদীয়া ও ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত এ বিদ্রোহে বর্ণহিন্দুর অত্যাচারে জর্জরিত অনেক হিন্দু কৃষকও অংশগ্রহণ করে। এতে গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হন।
তিতুমীরকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠায়। কিন্তু আলেকজান্ডার যুদ্ধে পরাস্ত হয়৷ এরপর বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণের এক যুদ্ধে নদীয়ার কালেক্টর এবং নদীয়া ও গোবরডাঙ্গার জমিদারের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তীতুমীর জয়ী হন। তিতুমীর নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ওই বছর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজপুরে (বর্তমান সর্পরাজপুর) শত শত লোক জড় করে শুক্রবার জুমার নামাজরত অবস্থায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন দু’জন মৃত্যুবরণ করেন ও অসংখ্য যোদ্ধা আহত হন।
১৮৩১ সালের ১৭ অক্টোবর সরফরাজপুর থেকে নারকেলবাড়িয়ায় চলে আসেন তিনি। ২৩ অক্টোবর বাঁশ এবং কাদা দিয়ে দুই স্তরবিশিষ্ট বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। বাঁশের কেল্লা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ। এ সময় তার অনুসারী সংখ্যা প্রায় ৫,০০০ জন।
২৯ অক্টোবর কৃষ্ণদেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর এ বিষয়ে মামলা দায়ের করতে গেলে কোনো ফল হয় না। ৬ নভেম্বর কৃষ্ণদেব আবার নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ করে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে হতাহত হয় প্রচুর। এরপর গোবরডাঙ্গার আটি নীলকুটির ম্যানেজার মি. ডেভিস ৪০০ হাবশি যোদ্ধা নিয়ে নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করলেন। শেষ পর্যন্ত মি. ডেভিস প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ২-৩ দিন পর জমিদার দেবনাথ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে সংঘর্ষে প্রাণ হারান। আরও কয়েকটি সংঘর্ষের পর ১৩ নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য ও দুটি কামানসহ নারকেলবাড়িয়ায় পাঠান। প্রচণ্ড সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। দারোগা ও একজন জমাদ্দার বন্দি হন।
১৯ নভেম্বর গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে সেনাবহর পাঠান। স্টুয়ার্ট বিরাট সেনাবহর ও গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করেন। তিতুমীরের ছিল মাত্র চার-পাঁচ হাজার সৈনিক। ছিল না পর্যাপ্ত গোলাবারুদ-বন্দুক। তবুও প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। কিন্তু তারা তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দীর্ঘসময় দাঁড়াতে পারেননি। গোলার আঘাতে ছারখার হয়ে যায় কেল্লা। শহীদ হন বীর তিতুমীরসহ অসংখ্য মুক্তিকামী সৈনিক। ২৫০ জনেরও বেশি সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দি করে। পরে এদের কারও কারাদণ্ড আবার কারও ফাঁসি হয়।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/জেএম/শাহ/জানুয়ারি ২৭, ২০১৪)