অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক বাড়ছে
জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক বাড়ছে। দেশকে একটি মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে সরকার। আর এ জন্য ২০০৯ সালে ৫ বছর মেয়াদি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা ২০১৫ সালে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এ পরিকল্পনায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
তবে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখাই বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য বলে এর আগে জানিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। দায়িত্ব নেওয়ার পর মিডিয়ার সামনে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি বর্তমান যা আছে তার মধ্যেই ধরে রাখার চেষ্টা করা হবে।
সরকারের অর্থনৈতিক থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার যে পার্থক্য তা কমিয়ে আনতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। নতুনভাবে তৈরি হতে যাওয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বাস্তবতার সঙ্গে পরিকল্পনার ফারাক কমানোর চেষ্টা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নের শুরুর অর্থবছরে (২০১০-১১) জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।
তার পরের অর্থবছরে (২০১১-১২) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
গত অর্থবছরে (২০১২-১৩) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে সংশয়।
অন্যদিকে খাতওয়ারিও অর্জিত প্রবৃদ্ধি ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
কৃষি খাত : ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৫ শতাংশ। ওই অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ২ দশমিক ২ শতাংশ।
শিল্প খাত : ২০১০-১১ অর্থবছরে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ওই অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময় প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ।
সেবা খাত : এ খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার বর্তমানে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন দেয়া হয় এই ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় ৫ বছরে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, ৯২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা, মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং মোট দেশজ বিনিয়োগ (জিডিপির অংশ) ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৩ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। মোট বিনিয়োগের ৭৭ শতাংশ ব্যক্তি খাত থেকে, যার পরিমাণ ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬০ কোটি। আর সরকারি অর্থায়ন ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট বিনিয়োগের ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা মোট বিনিয়োগের ৯০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ ছাড়া পরিকল্পনা মেয়াদ শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা এবং গড় রিজার্ভ ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা হবে।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এমডি/শাহ/জানুয়ারি ২৮, ২০১৪)