উপজেলা নির্বাচন
ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল বিএনপির
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : উপজেলা নির্বাচনকে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল হিসেবে নিতে চাচ্ছে বিএনপি। একদিকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ফের রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় করা, অন্যদিকে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ প্রকাশের সুযোগ করে দিতেই দলটি এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বিএনপি মনে করছে, উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে অদূর ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। পাশাপাশি দেশে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় ফিরতে সরকারকেও বাধ্য করা যাবে। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম, খুন, ক্রসফায়ার প্রভৃতি বন্ধ হবে।
বিএনপি সূত্র মতে, উপজেলা নির্বাচনকে সরকার পতন আন্দোলনের কৌশলের অংশ হিসেবেই নিচ্ছে দলটি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতা ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মাঝে যে হতাশার সৃষ্টি হয়, তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করবে দলটি। একই সঙ্গে এই নির্বাচনকে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের সাংগঠনিকভাবে ধরে রাখা ও রাজনীতির মাঠে ফের সক্রিয় করার উপায় হিসেবেও দেখছে বিএনপি। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিমও গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন উপজেলা নির্বাচন সম্পর্কে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এ নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির স্থানীয় নেতারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে হবেন, এ ব্যাপারে তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
ড. মোশাররফ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সমর্থনের কোনো নির্দেশনার ব্যাপারে আমি ঠিক জানি না। এ ব্যাপারে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ভালো বলতে পারবেন।’
তবে দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দলের স্থানীয় নেতারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এ ব্যাপারে কোনো বাধা নেই। যেহেতু এটা দলীয় নির্বাচন নয়, তাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি কিছু করছে না। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করবেন দলের সিনিয়র নেতারা।
মাহবুবুর রহমান বলেন, এই নির্বাচনের একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। তাই বিএনপি বিষয়টিকে সেভাবেই বিবেচনা করছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্যে দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে ইসির এ আইনকে প্রায়ই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আমলে না নিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেদের প্রার্থীর কথা নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেবে। উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের একক প্রার্থী দেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক ঐকমত্য হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় দেশের ৯৭টি উপজেলায় ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা না হলেও স্থানীয়ভাবে দলের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারা স্ব স্ব এলাকায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী নির্ধারণে স্থানীয় নেতাদের উৎসাহিত করছেন।
দলটির নেতারা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তাদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের ফোন করে স্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা না দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রশাসনের চাপ থেকে বেরিয়ে আসা ও কর্মীদের সক্রিয় করার জন্য এ নির্বাচনকে সুযোগ হিসেবে দেখছে তৃণমূলের নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, আগামী দিনের আন্দোলনের জন্য নেতাকর্মীদের এই উৎসাহ কাজে লাগানো যাবে। মূলত রাজনীতি ও আন্দোলনে ঘুরে দাঁড়াতে সারাদেশে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক ভিত্তি সুসংহত করতে চায় দলটি।
জানা যায়, উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে কেন্দ্র এবং সংশ্লিষ্ট জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং যতটা সম্ভব দল ও জোটের পক্ষ থেকে প্রতিটি উপজেলায় একক প্রার্থী দিতে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। ঘোষিত ৯৭ উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হিসেবে নিজেদের মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল সদর উপজেলা থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, যেহেতু উপজেলা নির্বাচন নির্দলীয় নির্বাচন, সেহেতু দলীয়ভাবে এ নির্বাচনে যাওয়ার কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। তাই জেলা বিএনপি ও ১৯ দলীয় জোট নেতারা একত্রে বসে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় আমাদের একক প্রার্থী মনোনীত করেছেন। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।
ফরহাদ আরও বলেন, ‘বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণ উদগ্রীব হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের কারচুপির হাত থেকে ভোট রক্ষা করাই এখন আমাদের মূল টার্গেট। আমরা উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আগামী ৬ মাসের মধ্যে সরকার পতনের আন্দোলনে এ বিজয়কে ব্যবহার করতে চাই।’
খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ইউসূফ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, কেন্দ্র থেকে এখনও কোনো নির্দেশনা না পেলেও যেহেতু না করা হয়নি, সেহেতু আমরা খাগড়াছড়ির ৫টি উপজেলাতেই প্রার্থী দিচ্ছি। আমাদের নেতাকর্মীদের ধরে রাখার লক্ষ্যেই আমরা উপজেলা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছি। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা সামনের সরকার পতন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক চৌধুরী। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, সিলেট জেলায় ১৯ দলীয় জোটের একক প্রার্থী নির্ধারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী জেলা নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি একক প্রার্থী নির্ধারণে জেলা নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। যদি তারা ব্যর্থ হন তখন কেন্দ্র একক প্রার্থী নির্ধারণে কাজ করবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন সিলেট মহানগর ছাত্রদলের দপ্তর-সম্পাদক রকিবুল হক চৌধুরী। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। দল ও জোটগতভাবে একক প্রার্থী নির্ধারণে সিনিয়র নেতারা কাজ করছেন। আশা করি, দল ও জোটের একক প্রার্থী হিসেবে আমি মনোনয়ন পাব।
রকিব বলেন, উপজেলা নির্বাচনের বিজয় ঘরে তুলে সরকার পতন আন্দোলনকে জোরালো করতে হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি শুরু থেকেই আস্থা না থাকার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হলেও উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে, সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে গুছিয়ে আনতে স্থানীয় নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনে থাকছে বিএনপি।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস/এইচএসএম/সা/জানুয়ারি ২৮, ২০১৪)