মামা শ্বশুরের পরামর্শে হাবিবের ব্যাংক ডাকাতি
আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : সোনালী ব্যাংক কিশোরগঞ্জের প্রধান শাখায় অভিনব পদ্ধতিতে ডাকাতির ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে এর মূলহোতা হাবিব ওরফে সোহেল ও তার বন্ধু ইদ্রিসকে রাজধানীর কদমতলীর বালুমাঠ এলাকার তনয় ভিলা নামের একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব।
মামা শ্বশুরের পরামর্শে ব্যাংক ডাকাতি করেন বলে সাংবাদিক সম্মেলনে জানান হাবিব। রাজধানীর উত্তরায় র্যাবের কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গ্রেফতার হাবিব স্বত:স্ফূর্তভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
হাবিব জানান, ব্যাংকের পাশে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দেড় বছর ধরে সুড়ঙ্গ খোড়া শুরু করেন। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যা ৮টায় সোনালী ব্যাংকের ভিতরে প্রবেশ করেন। এরপর মূল অপারেশন শুরু করেন রাত ১০টা থেকে। টানা চার ঘণ্টা ব্যয় করে রাত ২টার দিকে ব্যাংক ডাকাতির কাজটি সম্পন্ন করেন তিনি।
হাবিবের কাছ থেকে ১৬ কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক থেকে ডাকাতি হয় ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সাংবাদিক সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান জানান, চাঞ্চল্যকর এ ডাকাতি ঘটনার পরই র্যাবের একটি চৌকস টিম ঘটনার রহস্য উন্মোচন এবং জড়িতদের গ্রেফতার করতে মাঠে নামে। অপরাধীদের ধরতে সম্ভাব্য সব পদ্ধতি ব্যবহার করে মূলহোতা হাবিবকে গ্রেফতার করে র্যাব।
তিনি আরো জানান, তদন্ত শেষে এই ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার দিন ব্যাংকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ছিল। টেবিলের উপরে রাখা টাকাই কেবল ডাকাতি হয়েছে।
একটি আঞ্চলিক ব্যাংকে এতো টাকা রাখা হয়েছে কেন? জানতে চাইলে ডিএমডি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আঞ্চলিক শাখা হলেও এটা জেলার মূল শাখা। এ কারণে এখানে সব শাখার টাকা রাখা হয়। বেসরকারি অনেক ব্যাংকের টাকাও সোনালী ব্যাংকে রাখা হয় বলেও তিনি জানান।
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি ছিল কি না জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে। এরই মধ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, যদি ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্রমিক থেকে ব্যাংক ডাকাত :
কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংক ডাকাতির মূলহোতা হাবিবের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়। হাবিব শ্যামপুর এলাকায় দীর্ঘ ১৫ বছর পলি ক্যাবল কোম্পানীতে শ্রমিকের কাজ করেছেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি বিয়ে করেন কিশোরগঞ্জ জেলার সাদিয়া আক্তারকে। এরপর ২০০৮ সালে শ্রমিক পেশায় দুবাই গমন করে। ২০১১ সালে সেখান থেকে উপার্জিত ৭ লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
হাবিবের পটুয়াখালীর বাড়িটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তিনি কিশোরগঞ্জে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এ সময় হাবিব দুই লাখ টাকা দেনা শোধ করেন। বাকি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে মামা শ্বশুর সিরাজ ফোরম্যানের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন।কিন্তু মামা শ্বশুর সব কিছু দখল করে নেন। পরবর্তীকালে হাবিব তার নিকট টাকা দাবি করলে টালবাহানা শুরু করেন। মামা শ্বশুর তাকে টাকা না দিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে ব্যাংক ডাকাতির পরামর্শ দেন। মামা শ্বশুরের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাংকের পাশেই একটি বাসা ভাড়া নেন। সেই বাসার ভাড়া পরিশোধ করতেন মামা শ্বশুর। এ সময় তার ছদ্মনাম দেওয়া হয় সোহেল এবং এলাকায় প্রচার করা হয় তিনি কাঠের ব্যবসা করেন।
বাসা ভাড়া নেওয়ার প্রায় এক-দেড় মাস পর থেকেই সুড়ঙ্গ খোড়া শুরু করেন হাবিব। সুড়ঙ্গ খুড়তে শব্দ হয় বলে রাতে না করে দিনের বেলায় খোড়ার কাজ করতেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান, দিনে যানবাহনের শব্দ হয় বলে খোড়ার শব্দ টের পাওয়া যেত না।
এরপর দীর্ঘ দেড় বছর সুড়ঙ্গ খোড়ার পর এক সময় ব্যাংকের বারান্দার অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে হাবিব। এ সময় ভয় পেয়ে ডাকাতি করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। কিন্তু মামা শ্বশুর সিরাজ তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেন। এমনকি পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখান তাকে।
পরবর্তী সময়ে হাবিব ব্যাংকের ভল্ট রুম ভাঙ্গার জন্য সিরাজের কাছে ড্রিল ও কার্টার মেশিন চান। সিরাজ তাকে এগুলো কিনে দেন।
এ সময় তিনি ব্যাংকের ভল্টের অবস্থান ও টাকার বিষয় জানার জন্য কৌশলে ব্যাংকের এমএলএসএস আবু বকরের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন।
আবু বকর হাবিবের উদ্দেশ বুঝতে না পেরে সব তথ্য দিতেন। দীর্ঘ দিন ধরে খোড়ার পর ফ্লোর ভাঙ্গার কাজটি শেষ হলে শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ব্যাংকের ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি।
ব্যাংকের ভল্ট রুমে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পান টেবিলের উপর সব টাকা ছড়ানো আছে। এরপর তিনি সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে চলে আসেন এবং এশার নামাজ পড়ে ১০টার দিকে আবার ব্যাংকে প্রবেশ করেন।
এরপর টানা চার ঘণ্টার অপারেশনে তিনি ১০টি বস্তায় করে সব টাকা নিয়ে বাসায় রাখেন। সারা রাত টাকা গুছিয়ে ৫টি বস্তায় ভরে সকাল ১১টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে টাকার বস্তা নিয়ে রওনা হন। এভাবেই শ্রমিক হাবিব হয়ে উঠেন ব্যাংক ডাকাত।
এর আগে সকালে তিনি একটি চালের আড়ত থেকে ৫ লাখ টাকার ২৩০ বস্তা চাল ক্রয় করেন। এরপর একটি ট্রাক ভাড়া করে চাল ও টাকার বস্তা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ওই দিনই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ৮ বস্তা চাল ও টাকাগুলো নিয়ে রাখা হয়। বাকি চালের বস্তা আটরশির একটি ওরস শরীফে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে হাবিবের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া তার বন্ধু ইদ্রিস বলেন, আমি কিছু জানি না। আমাকে বাসায় আসার জন্য হাবিব ফোন করেন। তাই আমি তার বাসায় আসি।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/এসএ/এসবি/২৯ জানুয়ারি, ২০১৪