আপিলেও নিজামীর ফাঁসি বহাল
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর (৭২) বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রীম কোর্ট।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ বুধবার সকালে এ আদেশ দেন।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন—নাজমুন আরা সুলতানা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগে নিজামীর ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই চারটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি অভিযোগে নিজামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হওয়া ৮টি অভিযোগের মধ্যে আপিলে তিনটি অভিযোগে (২, ৬, ১৬ নম্বর অভিযোগ) মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে। আর দু’টি অভিযোগে (৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগ) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি অভিযোগ (১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ) থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী।
৩ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল : ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, পাবনার বাউশগাড়িতে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্থানী সেনারা হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হয় ৩০ থেকে ৪০ জন নারী। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসি বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
এ ছাড়া ১৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
২ অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল : ৭ নম্বর অভিযোগে পাবনার বৃশালিখা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফের বাবা সোহরাব আলীকে স্ত্রী-সন্তানের সামনে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
এ ছাড়া ৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে মুক্তিযোদ্ধা বদি, রুমি, জুয়েল ও আজমকে নিজামীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
৩ অভিযোগ থেকে খালাস : ৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, নিজামী পাবনার করমজা গ্রামে ৯ জনকে হত্যা ও একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
পাবনার নিজামীর উপস্থিতিতে শিক্ষক কছিমমুদ্দিনকে নির্যাতন ও আরও কয়েকজনকে ইছামতী নদীর পাড়ে হত্যা সংক্রান্ত ১ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিলে এ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও ক্যাম্প খুলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে বলে ৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়। এ অভিযোগে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিলে এ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
নিজামীর পক্ষে গত ৩০ নভেম্বর এবং ১ ও ২ ডিসেম্বর আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। এরপর ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন ও ৮ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন এবং রাষ্ট্রপক্ষের পাল্টা যুক্তি খণ্ডন শেষ হয়। ২০১৫ সালের বছরের ৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতের এ নেতার আপিল শুনানি শুরু হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এরপর ২০১২ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াতের এ নেতার বিচার শুরু হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান। স্বাধীনতাকামী বাঙলির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে আসে।
মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আনা হত্যা, বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়।
এ সব অভিযোগে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের পর নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ২৩ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামী আপিল করেন।
মোট ১৬৮টি কারণ দেখিয়ে এ আপিল করা হয়। ছয় হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার আপিলে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছিলেন তিনি।
(দ্য রিপোর্ট/এইচবিএস/এনডিএস/জানুয়ারি ০৬, ২০১৬)