পাঠ্যপুস্তকের সহায়ক হিসেবে নোট-গাইড প্রকাশ নিষিদ্ধ থাকলেও তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। চলতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বাজারে অবাধে নোট-গাইড বিক্রি হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

এদিকে শিক্ষা আইন-২০১৩ এ নোট-গাইড নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি রয়েছে প্রকাশকদের। আইনটি বাস্তবায়ন হলে তা চ্যালেঞ্জ করে আইনি লড়াইয়ের কথাও জানিয়েছেন তারা।

নোট-গাইড প্রকাশ নিষিদ্ধ হলে প্রকাশনা শিল্পের পাশাপাশি মুদ্রণ, বাঁধাই ও কাগজ শিল্প গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি করেছেন তারা। এ ক্ষেত্রে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। তাই খসড়া আইনটি সংশোধন করে বেসরকারি প্রকাশকরা যেন রেফারেন্স গ্রন্থ এবং সৃজনশীল পদ্ধতির অনুশীলনমূলক সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ ও বাজারজাত করতে পারে সে সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তবে নোট-গাইড বন্ধ হয়ে গেলে ব্যবসায় প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেছেন বই বিক্রেতারা।

বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর হোসেন বলেন, পাঠ্যতালিকা থেকে আমরা ইতোমধ্যে নোট-গাইড বন্ধ করে দিয়েছি। শিক্ষার্থী-অভিবাবকদের নোট-গাইড কিনতে নিষেধও করা হয়েছে। তবে নোট-গাইড বন্ধ না হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতেই শিক্ষার্থীরা তা কিনবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।

বাংলাবাজারে বই কিনতে আসা রাশেক রাশা বলেন, সব অভিভাবকই নতুন বছরের শুরুতে নোট-গাইড কিনে দেন। ফলে আইন মেনে বই না কিনলে শিশুরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই বই বন্ধ না হলে কিনে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সরেজমিনে বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি মাসের শুরু থেকেই অবাধে চলছে নোট-গাইড বিক্রি। পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সৃজনশীল বইয়ের নাম করে বাজারজাত করা হচ্ছে এ সব বই। অভিযোগ রয়েছে, কলেজের শিক্ষার্থীদের তৈরি নিম্নমানের বই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে নামিদামি স্কুলের শিক্ষকদের নামে। বই বিক্রেতারা এ জন্য দায়ী করেছেন প্রকাশক ও আইন প্রণেতাদের। তবে এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকাশকরা। তাদের বক্তব্য- নোটবই প্রকাশ বন্ধ করলে শিক্ষার্থীদের চাহিদা বিবেচনা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিম্নমানের বই বের হবে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাণিজ্যিক নোট ও নিম্নমানের প্রকাশকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর সিকদার লোটন দ্য রিপোর্টকে বলেন, শিক্ষার আধুনিকায়নে এ ধরনের আইন প্রশংসনীয়। তবে সরকারের যেমন যুক্তি আছে তেমন আমাদেরও কিছু যুক্তি আছে। নোট-গাইড ক্ষতিকর হলে অভিভাবকরা সন্তানকে তা কিনে দিত না। সরকারের উচিত ছিল উভয়পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে আইনটি করা।

সম্প্রতি নোট-গাইড বিক্রির দায়ে খুলনায় মুখলেসুর রহমান নামের একজন প্রকাশককে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও সরকারিভাবে আইনটি প্রণয়ন হয়নি। কিন্তু খসড়া আইন অনুযায়ীই অনেক প্রকাশককে হয়রানি করা হচ্ছে।

নোট-গাইড বন্ধ হয়ে গেলে বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে দাবি করে তিনি বলেন, বইয়ের দোকান বন্ধ হলে সৃজনশীল বই প্রকাশও সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে ব্যবসা বাঁচাতে লাইব্রেরিগুলো স্টেশনারি দোকানে পরিণত হয়েছে। তাই আইনটি গৃহীত হলে আমরা আইনি লড়াইয়ে যাব।

তিনি আরও বলেন, আর্থিক অক্ষমতায় যারা নিজস্ব শিক্ষকের কাছে পড়তে পারে না তারা সহায়ক বইয়ের সহায়তা নেয়। এ ছাড়া বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় সহায়ক বই দরকার। বোর্ড বই সংক্ষিপ্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ কম থাকে। ফলে এই আইনটিতে যেমন তাদের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি পণ্ডিতরা বঞ্চিত হবে বই প্রকাশ থেকে। জাতি হবে মেধাশূন্য।

উল্লেখ্য, খসড়া শিক্ষা আইন ২০১৩ এর প্রথম অধ্যায়ের ৭ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করিবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমতি ব্যতীত উক্ত শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত হিসাবে কোনো বিষয় বা পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা যাইবে না।’

তৃতীয় অধ্যায়ের ২২ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করিবে। উক্ত বোর্ডের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত হিসাবে কোনো বিষয় বা পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করা যাইবে না।’

পঞ্চম অধ্যায়ের ৫১ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘গাইড বই, নোট বই তৈরি এবং সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

(দ্য রিপোর্ট/এলআরএস/এইচএসএম/এনআই/জানুয়ারি ৩০, ২০১৪)