স্কুলের পথে বন্য বানরের আক্রমণের ভয় নেই আর
চট্টগ্রাম অফিস : স্কুলে যাওয়ার পথে এখন আর বন্য বানরের আক্রমণের ভয় নেই। দুপুরে না খেয়েও থাকতে হবে না পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের। একটি মাত্র বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই বদলে গেছে তাদের জীবন। কেটে গেছে দুই শ’ বছরেরও বেশি সময়ের গ্লানি।
অবশেষে পূরণ হয়েছে স্বপ্ন। দীঘিনালার সীমানা পাড়ার শিশু শিক্ষার্থীরা এখন তাই খুশি। মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তাদের এই অধরা স্বপ্ন পূরণ করেছে। দুই শ’ বছর পর একটি বিদ্যালয় পেল দুর্গম পাহাড়ি জনপদ সীমানা পাড়ার মানুষ। প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয়ে মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন সেখানে একটি নিকেতন তৈরি করে দিয়েছে।
কোমল বিদ্যার্থীদের পদচারণায় মুখর এখন দুর্গম পাহাড়ি জনপদ সীমানা পাড়া। এখন আর তাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হবে না। দুপুর বেলায় থাকতে হবে না না খেয়ে। একটি নতুন বিদ্যালয় পাল্টে দিয়েছে পুরো গ্রামের চিত্র। যেখানে আগে ছিল ঝোপ-জঙ্গল আর বানরের আনাগোনা সেখানে এখন প্রতিদিন সকাল থেকে বিকালে চলছে কচি-কোমল শিক্ষার্থীদের হই হুল্লুড়।
গত ১৯ ডিসেম্বর শনিবার বিকালে খাগড়াছড়ির সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন। বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয়েছে হোসনে আরা মনজুর বিদ্যা নিকেতন। সাবেক মেয়র মনজুর আলম ও তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্কুলটি। স্কুল নির্মাণের অর্থ ব্যয় হয় মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে। ৫০ শতক জমির উপর মনোরম পাহাড়ি পরিবেশে একশ ফুট দৈর্ঘ্য ও পঁচিশ ফুট প্রস্থের তিন তলা ফাউন্ডেশনের উপর আপাতত টিনের ছাউনির ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার ও খেলার মাঠ।
বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬ জন শিক্ষক। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পোশাকের পাশাপাশি শীতের সোয়েটার ও প্রতিজনের জন্য কম্বলও দেওয়া হয়েছে। নতুন বিদ্যালয় নতুন পোশাক আর সঙ্গে নতুন শীতের কাপড় পেয়ে আনন্দে অনেকটা আত্মহারা এ দুর্গম অঞ্চলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।
দীঘিনালার নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রিটন ত্রিপুরা জানান, তার বাড়ি তৈদুছড়া এলাকায়। বিদ্যালয় থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে। সে প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘর থেকে বের হতো। আর বিদ্যালয়ে পৌঁছাত সকাল ৮টায়। আবার বিকাল ৪টায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়িতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টায় বেজে যেত। প্রতিদিন পাহাড়ি পথে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসত হতো। সকালে ঘর থেকে খাবার খেয়ে আবার রাতে বাড়িতে ফিরে খাবার খেতে হতো তাদের।
রিটন ত্রিপুরার মতো ২০ জন শিশু শিক্ষার্থী এভাবেই কষ্ট করে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসত প্রতিদিন। দীঘিনালার সীমানা পাড়া গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে পড়াশোনা করত। আবার অনেক শিশু বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় পড়াশেঅনাই করত না।
সীমানা পাড়া গ্রামের পুরোহিত পরানধন ত্রিপুরা (৫৫), ধনরঞ্জন ত্রিপুরা (৬০), পিলানী ত্রিপুরা,যদু মোহন ত্রিপুরা, নিরণ বালা ত্রিপুরা ও সুমন্তি ত্রিপুরার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, সীমানা পাড়ায় ১০০টিরও বেশি পরিবার রয়েছে। ৪০ পরিবার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার আর ৪০ পরিবার দীঘিনালা উপজেলার। তৈদুছড়া এলাকায় রয়েছে ৭০ পরিবার।
দুই গ্রামের দেড় শ’ পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার জন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। গ্রামের কয়েকজন শিশু ব্র্যাক স্কুলে ও কিছু কিছু শিশু ৯ মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক দূরের বিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় ঝড়-বৃষ্টি হলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারতো না। ছয়-সাত-আট কিলোমিটার পথ হেঁটে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে বাধ্য হয়।
রহি রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় তার দুই মেয়ে একজন দ্বিতীয় শ্রেণী ও আরেকজন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তাদের খাগড়াছড়ি সদরে ভাড়াবাসায় রেখে খাগড়াপুর সরকারি প্রাথিমক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুবই দরকার ছিল। তাদের গ্রামের ৬০ জন শিশু শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। গ্রামে বিদ্যালয় নির্মাণ হওয়ায় তারা খুবই আনন্দিত।
নতুন বিদ্যালয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢল নামে মানুষের। সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় দুর্গম এ পাহড়ি জনপদ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন সাবেক মেয়র মো. মনজুর আলম। স্বাগত বক্তব্য দেন উন্নয়নকর্মী বিনোধন ত্রিপুরা। মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য মো. দিদারুল আলম এতে সভাপতিত্ব করেন।
এ সময় বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক মেয়রপত্নী হোসনে আরা বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মো. আবদুর রহমান, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল মহসীন রেজা, দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, দীঘিনালা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সামশুল আলম, মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ সভাপতি নিজামুল আলম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সারোয়ার আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
(দ্য রিপোর্ট/এমএম/এসআর/সা/জানুয়ারি ০৮, ২০১৬)