জহির রায়হান
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হন। তাকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ‘কালচারাল আইকন’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ও সৈয়দা সুফিয়া খাতুন দম্পতির সন্তান জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ছেলেবেলায় ডাকা হতো জাফর নামে। তার বড় ভাই সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার।
নিজ পরিবারেই জহির রায়হানের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। শৈশব-কৈশোর ও স্কুলজীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪০ সালে কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তি হন। তার বাবা তখন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। মডেল স্কুলে তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেইন) থেকে সপ্তম শ্রেণী পাস করে আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবার সঙ্গে মজুপুর গ্রামে চলে আসেন। গ্রামের আমিরাবাদ হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর এক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ে বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স পাস করেন। এরপর এমএ ক্লাসে ভর্তি হন।
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ‘খাপছাড়া’ পত্রিকায়। বড় বোনের স্বামী এমএ কবীর ও ড. আলিম চৌধুরী সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে ‘প্রবাহ’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ‘সমকাল’, ‘চিত্রালী’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সিনেমা’, ‘যুগের দাবী’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘চিত্রালী’-তে ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে কিছুদিন একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।
১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে এ জে কারদার পরিচালিত ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ‘যে নদী মরুপথে’ ছবিতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৪ সালে উর্দুতে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন।
তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’য়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় ‘জীবন থেকে নেওয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটকের মতো বিখ্যাত নির্মাতারা প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশ মুক্তি পরিষদ (Bangladesh Liberation council of Intelligentsia)-এর সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’-র মতো কালজয়ী প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এ ছাড়া অন্যান্য পরিচালকের কাজের তত্ত্বাবধানও করেন।
তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), বরফ গলা নদী (১৯৬৯) ও আর কত দিন (১৯৭০)। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সূর্যগ্রহণ (১৯৫৫), তৃষ্ণা (১৯৬২), একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০) ও কয়েকটি মৃত্যু। সম্পাদিত পত্রিকা হলো- এক্সপ্রেস (ইংরেজি সাপ্তাহিক) ও প্রবাহ (বাংলা মাসিক)।
জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র হলো- কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২, কলিম শরাফীর সঙ্গে যৌথভাবে), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭), বেহুলা (১৯৬৬), জ্বলতে সূরযকে নীচে, জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) ও লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত) (১৯৭০)। এছাড়া বেশ ক’টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি।
সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। উল্লেখযোগ্য হলো- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪, হাজার বছর ধরে), নিগার (কাঁচের দেয়াল, শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭১, সাহিত্য: মরণোত্তর, ১৯৭২ সালে ঘোষিত), একুশে পদক (১৯৭৭, চলচ্চিত্র : মরণোত্তর) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯২, সাহিত্য : মরণোত্তর)।
জহির রায়হান দুবার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা দেবী। প্রয়াত এই অভিনেত্রীর দুই ছেলে- বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই নাট্য নির্মাতা। দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী সুচন্দার ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা।
জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। বলা হয়ে থাকে বিহারি ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এএস/জানুয়ারি ৩০, ২০১৪)