সাড়ে ৩ দিনের ঢাকা টেস্ট
আরিফ সোহেল, দ্য রিপোর্ট : চলছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের দ্বিতীয় সেশনের ব্যাটিং পর্ব। মধ্য দুপুর। গ্যালারি তখন সকলের জন্যই উন্মুক্ত। কিন্তু বিষয়টি জানা ছিল না এমন একজন বুকে সাহস জুগিয়ে ঢুকে পড়েছেন স্টেডিয়ামে। নাম ইকবাল; কলেজ পড়ুয়া। স্কোরবোর্ডে না তাকিয়ে গা ভাসালেন বিপুল আনন্দ-উত্তেজনায়। অনেকটা না বুঝেই। গ্যালারিজুড়ে তখন রাজ্যের উৎসব। চলছে চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং; উইকেটে রুবেল-আলি আমিন। ‘পরাজয়ে ডরে নাহি বীর’ এই মন্ত্রে বলিয়ান তারা। মাত্র ৬.২ ওভার ব্যাটিং তাণ্ডব চালিয়ে ৮.৩৮ গতিতে রান তুলে মাতোয়ারা করেছেন দর্শকদের। তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ; টিকিট ছাড়া গ্যালারিতে আসা ইকবাল। তিনিও গলা ছাড়লেন আনন্দ মিছিলে।
আনন্দ-উন্মাদনার শব্দ হাওয়া মিলিয়ে যেতে সময় লেগেছে মাত্র মিনিট ২৭। উৎসব মঞ্চে যোগ দেয়া ওই ইকবাল বাস্তবতায় ফিরে যখন এসেছেন, ততক্ষণে শবযাত্রা শুরু। ভাঙা হাটে তখন বিদায় ও হারের বেজায় করুণ সুর। শেষ যুগলের এমন ধুন্ধুমার ব্যাটিং বৃহস্পতিবার মিরপুরে ‘আনন্দ-বিনোদনের’ উপলক্ষ এনে দিয়েছে বটে। হয়ত তাতেই ওমন নির্মল আনন্দে ইকবালের মতো অনেকে টেস্টে বড় হারের দুঃখ ভুলে গেছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা; আরও একটি রড় হারের কলঙ্কটীকার কথা। তাও মাত্র সাড়ে ৩ দিনে!
ঢাকা টেস্টে সর্বশেষ তথ্য, বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২৩২ রানে অলআউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তুলেছে ২৫০ রান। শ্রীলঙ্কা ৭৩০/৬ ইনিংস ঘোষণা করেছিল। শ্রীলঙ্কা ইনিংস ও ২৪৮ রানে জয়ী।
দেখতে দেখছে ৮২টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৩৬টিতেই হেরেছে ইনিংস ও রানের ব্যবধানে। এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ ঢাকাসহ ১৫টি টেস্টে মধ্যে ৮ বারই ইনিংস ব্যবধানে হার দেখেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি মাত্র টেস্ট ড্র নিয়েই খোরোখাতা চলছে।
বাংলাদেশ এর আগে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে। ২০০২ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ওই হার ছিল ইনিংস এবং ৩১০ রানের। এটা বিশ্ব রেকর্ডবুকে সপ্তম বড় ব্যবধানে হার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫৩৬ রানে জবাবে বাংলাদেশ তুলেছিল যথাক্রমে ১৩৯ ও ৮৭ রান।
অবশ্য রেকর্ড বড় জয় এখনো ইংলিশদের দখলে। তারা হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে এক ইনিংস ৫৭৯ রানে। ১৯৩৮ সালে ওভালে ইংল্যান্ডের ৯০৩ রানের জবাবে দুই দফা ব্যাটিং করে তুলেছে মাত্র ৪২৪ রান (২০১ ও ২২৩)।
শ্রীলঙ্কার এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবধানের জয়। এর আগে তারা জিম্বাবুয়েকে এক ইনিংস ও ২৫৪ রানে হারিয়েছে। আর বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বাধিক ব্যবধান। এর আগে ২০০৭ সালে কলম্বোতে বাংলাদেশকে ইনিংস ও ২৩৪ রানে হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা মাত্র ৫৭৭ রান তুলে। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩২.৩ ওভারে ৮৯ রানে অলআউট হয়েছে। আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৭.১ ওভার ব্যাটিং করে তুলেছে ২৫৪ রান।
বৃহস্পতিবার মিরপুরের মরা উইকেটে এক মমিনুলের হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে মিডল অর্ডারের জোড়া অঙ্কের রানে বাংলাদেশ পৌঁছেছিল ২ শ’ কাছাকাছি। ১৯৭/৯-এ নাসিরের চলে যাওয়ায় পর ওখানেই শেষ দেখেছেন অনেকেই। কারণ উইকেটে তখন বাকি দুই বোলার। অনেকেই রাবণের ধৈর্য নিয়ে তখনও বসেছিলেন। বাংলাদেশের ওপরের দিকে হতাশার ব্যাটিংয়ের পর রুবেল-আল আমিন যে বিনোদন পসরা সাজিয়েছেন; তা রীতিমতো বিস্ময়কর। তারা প্রমাণ করেছেন মরা উইকেটে ব্যাটিং কতটা সহজ। শেষ জুটিতে ৫৩ রান অনেকে অনুপ্রেরণাও মানছেন। বিশেষ করে হার্ড সিমার তত্ত্বে দলে স্থান পাওয়া আল-আমিন সাইক্লোন বইয়ে দিয়েছেন। ২৭ মিনিট উইকেট আগলে রেখেছেন শেষ জুটি। খেলেছেন ৩৮ বল; করেছেন ৫৩ রান। এমন ব্যাটিং শুধু টোয়েন্টি২০ ম্যাচেই দেখা যায়। তাই দেখেছেন ইকবাল; তাতে পুলকিত হয়েছেন। হয়েছেন আত্মহারাও। আল-আমিনের ৪টি ছক্কায় শেষ উন্মদনায় মেতে উপলক্ষ তৈরি করেছে। ১৮ বলে ২৭ মিনিটে ওই রান তুলেছেন তিনি। তার সঙ্গী রুবেল ছক্কা না মারলেও নির্বিঘ্নে ব্যাটিং করে ৩ বাউন্ডারিতে তুলে নিয়েছেন ১৭ রান। ৩৪ মিনিট উইকেটে পড়ে থাকা এই বোলার-ব্যাটার খেলেছেন ২৩টি বল।
তৃতীয় দিনে ৪৯৮ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমেছিল বাংলাদেশ। চতুর্থ দিন প্রথম ওভারের দ্বিতীয় শামসুর রহমান শুভর (৯) বিদায় জানিয়েছে; কী ঘটতে যাচ্ছে দিন শেষে। দলের তখনও ৩৫/২। না, দিনও শেষ করতে হয়নি। বলা যায় দিনের মধ্য সময়েই শ্রীলঙ্কা তাদের কথা রেখেছে। আগের দিন মাহেলা বলেছিলেন, আমরা আরও বেশি আক্রমণাত্মক খেলব। হয়েছে তাই। ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন মাত্র ৪২.৫ ওভার বোলিং মোকাবেলা করার সুযোগ নিয়েছে। নিয়েছে মানে; চাইলে তারা আরও পারতেন। যা ম্যাচ শেষে মুশফিক বলেছেন, ‘আমাদের আরও ভালো ব্যাটিং করার যোগ্যতা রয়েছে।’ এরপর দ্রুতযাত্রার মিছিলে প্রথম স্লোগাল তুলেছেন মার্শাল আইয়ুব (১৮)। সেই মিছিলে পালাক্রমে একে একে যোগ দিয়েছেন সাকিব (২৫)। অবশ্য এই ফাঁকে সাকিব-মমিনুল তুলেছেন ৫২ রান। যা ঘুরে দাঁড়ানো স্বপ্নও দেখাচ্ছিল। কিন্তু প্রথম সেশনের শেষ দিকে মমিনুল-মুশফিক (১৪) চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ১৫০/৬। পরে শুধুই রানের পথে হেঁটেছেন নাসির-সোহাগ গাজী। সোহাগ গাজী ২টি ছক্কাও মেরেছেন। ২৩ রানে ফিরেছেন লাকমলের শিকার হয়ে। নাসির দলের পক্ষে ২৯ রান করেছেন পাক্কা এক ঘণ্টা উইকেট আগলে রেখে। বাকি গল্প দুই লেজের ব্যাটারের।
প্রথম ইনিংসে ২৩২ রানের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয়েছে ২৫০ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়টা ঘটিয়েছেন মূলত দিলরুয়ান পেরেরা ও সুরঙ্গা লাকমল। প্রথমবারের মতো এক ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন পেরেরা। আর ৩টি গেছে লাকমলের ঝুঁলিতে। ক্যারিয়ারে আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরির পুরস্কার পেয়েছেন মাহেলা; হয়েছেন ঢাকা টেস্টের ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ।
এমন জয়কে বড় বিজয়ে দেখে অ্যাঞ্জোলো ম্যাথুস বলেছেন, ‘এটা আসলে দলের বিজয়। যে যার কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। ব্যাটসম্যান-বোলার হয়ে যেভাবে জয় পেতে হয় হয়েছে তাই।’
আর হারের পুরো দায়-দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলেছেন, ‘প্রথম দিন থেকেই ব্যাটিং স্বর্গে আমরা ভালো খেলতে ব্যর্থ হয়েছি। যার খেসারত দিতে হয়েছে। আমরা আশাবাদী পরের টেস্ট আমরা ফিরে আসব।’
বাংলাদেশ : ২৩২ ও ২৫০
শ্রীলঙ্কা : ৭৩০/৬, ডিক্লিয়ার
ফল : শ্রীলঙ্কা ইনিংস এবং ২৪৮ রানে জয়ী
(দ্য রিপোর্ট/এএস/ওআইসি/সা/জানুয়ারি ৩০, ২০১৪)