চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের ধর্মঘট, দুর্ভোগে রোগীরা
চট্টগ্রাম অফিস : চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, চেম্বার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবাদান বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন করছেন চিকিৎসকরা। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখায় দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো রোগী ও তাদের স্বজনরা।
এক রোগীর মৃত্যু ও অপর এক রোগীর অস্ত্রোপচারকালে শরীরের ভেতরে ব্যান্ডেজ রেখে দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামে তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বুধবার থেকে এ ধর্মঘট আহ্বান করে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)।
নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ের সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায়, ‘ক্লিনিকে রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চলছে। তবে অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ আছে। যদি কোনো চিকিৎসক অপারেশনের দায়িত্ব নেন। তাহলে তার বিএমডিসি সার্টিফিকেট বাতিল করা হবে। তাই কোনো চিকিৎসকই রোগীদের অপারেশন করছে না।’
এদিকে বিএমএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান দ্য রিপোর্টকে জানান, তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বুধবার থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার না করা হলে ২৩ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, ‘ডা. শামীমা সিদ্দিকা রোজী, ডা. মাহবুব আলম ও ডা. রানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে হয়রানি ও মানহানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ থাকবে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল, ইউএসটিসি, আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চালু থাকবে।’
এদিকে বুধবার সকাল থেকে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে সেবা না পেয়ে রোগীরা ছুটছে সরকারি হাসপাতালের দিকে। ফলে চাপ বেড়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চমেক কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের ছুটিও বাতিল করেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নগরীর চকবাজার, জামালখান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে রোগীদের দুর্ভোগের চিত্র। চমেক হাসপাতালে বেশ কয়েকটি রোগের নিরীক্ষা (টেস্ট) হয় না বলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর নির্ভর করতেন রোগীরা। এ ধর্মঘটের ফলে নগরীর সব প্রাইভেট ক্লিনিকের পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে ডাক্তাররা।
এ নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।
জামালখান এলাকার সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে দেখা গেছে, সেবা না পেয়ে কয়েকজন রোগী হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। দোহাজারী থেকে খোরশেদ আলম তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে। তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।
তিনি বলেন, ‘প্রসব বেদনার কারণে কষ্ট হচ্ছে তার। গতকাল থেকে এ ক্লিনিক থেকে ওই ক্লিনিকে ঘুরেও কোথাও অপারেশন করাতে পারছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বুধবার ন্যাশনাল হাসপাতালে জানানো হয় ডাক্তার নেই, চিকিৎসা হবে না। পরে গিয়েছিলাম ডেল্টা হাসপাতালে, সেখানে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বলার পর উপস্থিত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর সিএসসিআর হাসপাতালে গিয়েছি, সেখানেও বলা হয়েছে চিকিৎসা হবে না। চিকিৎসা সেবা মানবিক সেবা, এটা নিয়ে কেন রাজনীতি চলবে?’
মেহেদীবাগ ন্যাশনাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, রোগীদের নিয়ে স্বজনরা বেশ বিপাকে পড়েছে। নতুন করে কোনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। যারা আগে থেকে ভর্তি আছে তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না বলে জানান রোগীর স্বজনরা।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বাবুল হোসেন নামে একজন বয়স্ক রোগী এই প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন, ‘আমার জন্য একজন ডাক্তারকে বলেন ভাই।’
চমেকের চর্মরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিকুল মাওলা দ্য রিপোর্টকে জানান, ‘ক্লিনিকগুলোতে সেবা না পেয়ে রোগীরা ভিড় করছেন সরকারি এই হাসপাতালে। আমরা রোগীদের সর্বাত্মক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
গত ৯ জানুয়ারি নগরীর সার্জিস্কোপ হাসপাতালে সন্তান প্রসবের পর চিকিৎসকদের অবহেলায় মৃত্যু হয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছোট ভাই খাইরুল বশরের মেয়ে মেহেরুন্নেছার। এ ঘটনায় ডা. মাহবুবুল আলম ও ডা. শামীমা রোজীকে দায়ী করা হয়। ঘটনার পর নগরী সার্জিস্কোপ ক্লিনিকে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে মন্ত্রীর স্বজনরা ডা. মাহবুবুল আলম ও ডা. শামীমা রোজী বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার আদালতে মামলা করেন।
এছাড়া অপর এক ঘটনায় চমেক হাসপাতালে অপারেশনের সময় নুরুল আবছার নামে এক কিশোরের রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. রানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে পৃথক একটি মামলা করেন ওই কিশোরের বাবা জেবল হোসেন।
এ দুটি মামলা আমলে নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিচারক মোহাম্মদ ফরিদ আলম পাঁচলাইশ থানা পুলিশকে এজাহার হিসেবে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দায়েরকৃত দুটি মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা।
(দ্য রিপোর্ট/জেএস/এপি/সা/জানুয়ারি ২১, ২০১৬)