পাভেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমী প্রতিভার নাম জহির রায়হান। স্বাধীন বাংলাদেশ আবির্ভাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার চলচ্চিত্র। বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকারের কথা, সংগ্রামের কথা। মুক্তিযুদ্ধে তার চলচ্চিত্র ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালীর প্রেরণার উৎস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে ষাটের দশকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সাহসিকতার পরিচয় দেন জহির রায়হান। এমন সাহসী মানুষটি হারিয়ে যান দেশ স্বাধীনতা হওয়ার মাত্র দেড় মাস পরে, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুর গিয়ে তিনি আর ফিরে আসেননি।

১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামের চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। তার কাহিনী অবলম্বনে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য তৈরি করেন। কিন্তু নির্মাণের অনুমতি দেয়নি পাকিস্তান সরকার। এমনকি এফডিসিতে জমা দেওয়া চিত্রনাট্যও ফেরত দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, এখনো এফডিসির পুরনো কাগজ ঘাঁটাঘাটি করলে পাওয়া যেতে পারে সেই চিত্রনাট্য। তবে তার স্ত্রী সুচন্দা ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও সেখানে চিত্রনাট্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সেবার না পারলেও ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন জহির।

এ চলচ্চিত্রটি নানা কারণে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে এই চলচ্চিত্রটি ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের বড় প্রেরণা। এ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটি পরে একুশের গান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই গানটিকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার পেছনে ‘জীবন থেকে নেয়া’ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ওই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে। তার মাত্র কয়েক বছর পর জহির গানটি ওই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এ ছাড়া ওই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ ও খান আতাউর রহমানের বিখ্যাত গান ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’। সবকটি গানই স্বাধীনতা, সাম্য ও অধিকার আদায়ের প্রেরণা সমৃদ্ধ।
সর্বোপরি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে মিশে আছে জহির রায়হানের নাম ও তার নির্মিত চলচ্চিত্র।

একনজরে জহির রায়হান

জহির রায়হান একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও রাজনীতিক। তিনি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বাবার কাজের সূত্রে অনেক বছর কলকাতায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পরিবারের সঙ্গে কলকাতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান চলে আসেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

পেশাগতভাবে জহির রায়হান সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে ‘যুগের আলো’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা প্রভৃত পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়।
১৯৫৭ সালে এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে। পরিচালক এহতেশাম তাকে ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে কাজের আমন্ত্রণ জানান। চলচ্চিত্রটির নামসঙ্গীত রচনা করেন জহির রায়হান। ১৯৬০ সালে ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দুতে), পরের বছর প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার চলচ্চিত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলে তা আমরা উপরে জেনেছি।
জহির রায়হান ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়।

জহির রায়হানের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭), বেহুলা (১৯৬৬), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) ও লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত, ১৯৭০)। তার রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০), হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), বরফ গলা নদী (১৯৬৯) ও আর কত দিন (১৯৭০)।

জহির রায়হান দু’বার বিয়ে করেন। ১৯৬১ সালে অভিনেত্রী সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন। ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী সুচন্দাকে।

(দ্য রিপোর্ট/পিএস/এআরই/এনআই/জানুয়ারি ৩০, ২০১৬)