সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। দলটির চলমান আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক সে সময় সংগঠনগুলোর অনেক নেতাই আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে অনেকে আবার আত্মগোপন অবস্থা থেকে গ্রেফতার হন। যে কারণে আন্দোলনে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখার আগেই ‘চুপসে’ যায় ছাত্রদল, যুবদলসহ দলের সব সহযোগী সংগঠন।

এ ছাড়া মামলা, গ্রেফতার, মেয়াদোত্তীর্ণ, নিষ্ক্রিয়তা, গ্রুপিং সব কিছু মিলে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো এলোমেলো অবস্থানে রয়েছে। এমনটাই মনে করছেন তৃণমূল কর্মীরা।

সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা যেমন আন্দোলন কর্মসূচিতে মাঠে নামতে পারেনি, তেমনি সঠিক নেতৃত্বের অভাবে কর্মীরাও এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। কর্মীদের অভিযোগ, গ্রেফতারের ভয়ে সিনিয়র নেতাদের আত্মগোপন, কিছু নেতার গ্রেফতার ও জুনিয়র নেতাদের সঠিক দিকনির্দেশনা না দেওয়ায় আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি দলটি। এর দায় বিএনপির প্রতিটি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের।

যুবদল

যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির কারণে কর্মীদের একেবারে ‘নিষ্প্রভ পারফরমেন্স।’ আন্দোলনে তাদের কার্যকর কোনো ভূমিকা ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রক্ষা করেনি। চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় কর্মীদের কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়েই আত্মগোপনে যান যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরবও গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন।

কর্মীদের অভিযোগ, দ্বন্দ্ব-কোন্দলে বিপর্যস্ত যুবদল। যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রকাশ্য। শীর্ষ নেতৃত্বের এ দ্বন্দ্বের সুযোগে সংগঠনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে বহু আগেই। ফলে যুবদল সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে অতীতের মত বিএনপির হাইকমান্ডের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কোনো ধরনের সমন্বয় ছিল না। সাংগঠনিক জেলাগুলোতে কেন্দ্র থেকে সক্রিয় কোনো নির্দেশনা না থাকায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে যুবদলের তৃণমূল নেতৃত্ব। যে কারণে খালেদা জিয়া বার বার আহ্বান জানিয়েও নেতাকর্মীদের রাজপথে নামাতে পারেনি।

এদিকে বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এ কমিটি গত বছর ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি করার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গা হয়নি। যার প্রভাব পড়েছে চলমান আন্দোলনে।

এ ব্যাপারে সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মোহাম্মদ হানিফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ৭৫ ভাগ জনগণের সমর্থন থাকার পরও আমরা আন্দোলনে সফল হতে পারিনি। এটা আমাদের সংগঠনের ব্যর্থতা।’

হানিফ বলেন, ‘গত বছর রমজানে যুবদলের কমিটি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজপথে আন্দোলেন করেছি। বর্তমানে চলমান আন্দোলনেও আমি মাঠে থেকে কাজ করছি। তাই আমি মনে করি, নেতৃত্বের জন্য সবাইকেই সুযোগ দিতে হয়।’

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১ মার্চ অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে সভাপতি ও সাইফুল আলম নীরবকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদসের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া ২০১ সদস্যবিশিষ্ট যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেন।

এদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গত শনিবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ জানান, হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে গত তিন মাসে যুবদলের ৯১ জন নেতাকর্মী নিহত হয়।

স্বেচ্ছাসেবকদল

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই শীর্ষ নেতা সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু গত ১৫ নভেম্বর থেকে জেলে আছেন।

স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী সোহেল চলে যান আত্মগোপনে। অন্য নেতারাও রাজপথে নামেননি।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ২৩ আগস্ট স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩৩৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এ কমিটি অনুমোদন করেন। এর আগে ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর হাবিব-উন-নবী সোহেলকে সভাপতি ও মীর সরাফত আলী সপুকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। কয়েক মাস পর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে শফিউল বারী বাবুকে মনোনীত করা হয়।

শ্রমিকদল

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান শ্রমিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাফরুল হাসান। এ ছাড়া কর্যকরী সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী।

নজরুল ইসলাম খান নয়াপল্টনের সমাবেশ থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। হাসপাতাল থেকে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এসে দুই একটি সংবাদ সম্মেলন ছাড়া তার আর কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। কার্যকরী সভাপতি আবুল কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক জাফরুল হাসানের নেতৃত্বে চলমান আন্দোলনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

২০১১-১৩ সালের জন্য ৩৫ সদস্যের জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৬ জুন ২০১১ জাতীয় কাউন্সিলে এ কমিটি করা হয়। এ সংগঠনটির ৬৪টি জেলায় কমিটি আছে। শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অধিকাংশই অগ্নিসংযোগ হামলা, বিস্ফোরণ ও ভাংচুরের মামলার কারণে গ্রেফতার এড়াতে লুকিয়ে আছেন। কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজ খবর রাখছেন না।

ছাত্রদল

ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কে বজলুল করিম চৌধুরী আবেদসহ দুই সহ-সভাপতি এবং দুই যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক জেলে রয়েছেন।

গ্রেফতারের আগেও চলমান আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়েনি। সারাদেশের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের ছিল দূরত্ব। আন্দোলনকে গতিশীল করতেই গত বছর ৩ সেপ্টেম্বরে আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে ছাত্রদলের সভাপতি ও হাবিবুর রশিদ হাবিবকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। গত ১৫ এপ্রিল সোমবার রাত ১০টার দিকে বিএনপির চেয়ারপারসনের স্বাক্ষরিত ২৯১ সদস্য বিশিষ্ট এ পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করা হয়। তবে সে সময় ২০১ সদস্যের কমিটির কথা বলা হলেও এখন তা করা হয়েছে ২৯১ সদস্য বিশিষ্ট। কিন্তু রাজপথের আন্দোলনে জ্বলে উঠতে পারেনি ছাত্রদল। এমনকি আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশও করতে পারেনি। এ নিয়ে ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল আগে থেকেই। ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির নেতৃত্ব নিয়েও সমালোচনা কম হয়নি।

কর্মীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্রদলের সামান্যতম আন্দোলনের ছোঁয়া। বিগত দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও বর্তমান কমিটি দেড় বছরেও একদিনের জন্য ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেনি।

কৃষকদল

কৃষক দলের সভাপতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।একই সঙ্গে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতিও।

দলের চূড়ান্ত আন্দোলনের মুহূর্তে মির্জা ফখরুল গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। অজ্ঞাত স্থান থেকে গণমাধ্যমে দুই একটা বিবৃতি ছাড়া আন্দোলনে তার কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। এই নিয়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যেও মির্জা ফখরুলের নেতৃত্ব নিয়ে উঠে সমালোচনার ঝড়। কর্মীদের অভিযোগ যেখানে দলের মহাসচিব সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবেন সেখানে তিনি নিজেই আত্মগোপনে চলে যান।

এ ছাড়া মহিলা দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, মৎসজীবী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল এবং জাতীয়তাবদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) সংগঠনগুলো যেন ‘প্রদর্শনী’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।

নেতারা যা বললেন

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে.(অব.) মাহবুবুর রহমান দ্য রির্পোটকে বলেন, আমরা দলকে সুসংহত করছি। বিশেষ করে সামনে আমাদের জাতীয় কাউন্সিল রয়েছে। এ কাউন্সিলের মাধ্যমে আবারও দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলো পুনর্জীবিত হবে।’

তিনি বলেন, চলমান আন্দোলনকে বেগবান করতে আমাদের সাংগঠনিক জেলা সফর রয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আমাদের আন্দোলনে নতুন মাত্রাযোগ হবে। এ ছাড়া আমরা এখন নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগুচ্ছি।

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন দ্য রির্পোটকে বলেন, নিয়ম আনুযায়ী দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো পুনর্গঠন হবে।

সহযোগী সংগঠনগুলোর আন্দোলন কর্মসূচির ব্যাপারে জানতে চাইলে রিপন বলেন, ‘সংগঠনগুলো আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি সফল করার জন্য কাজ করে। এর বাইরে যে কোনো বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’

বিএনপির সহ-যুব বিষয়ক সম্পাদক মহিবুল আলম স্বপন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজপথে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে হতাশার কথা ছাড়া বেশি কিছু বলা যাবে না। তবে এই মুহূর্তে এ ব্যাপারে কথা না বলাটাই ভালো।’

স্বপন বলেন, উপজেলা নির্বাচনের পর যুবদলের কমিটি গঠন হতে পারে। এখন এই ব্যাপারটি বলা যাচ্ছে না। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।’

(দ্য রির্পোট/এমএইচ/এইচএসএম/আরকে/জানুয়ারি ৩১, ২০১৪)