একুশের বইমেলা : সৃষ্টিশীলতার অফুরান ধারা
মিরাজ মোহাইমেন
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা জয়ের বাধভাঙা আনন্দ স্রোতধারার স্মৃতিচিহ্ন সাথে করে ফিরেছে একুশ। একুশ বাঙালির চেতনাকে শাণিত করে নিরন্তর। ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমির যে বইমেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়, তা এখন আমাদের জাতিসত্তার একটি স্পন্দিতক্ষণ। যে কারণে প্রত্যেকের ভেতরে আলাদা শিহরণ খেলা করে। নতুন লেখক আর পুরাতন লেখকের মধ্যে প্রকারান্তরে প্রতিযোগিতা জমে ওঠে সৃষ্টিশীলতার। বই আর মানবসত্তার নিবিড় চেতনালোক একটি সভ্যতার সব থেকে বড় উৎসারক।
সংস্কৃতির প্রাণ সঞ্চারে ভাবের যে উন্মেষ ঘটে তা তৈরি করতে নিয়ামকের ভূমিকা বইয়েরই। বই নিয়ে নানা জনের নানা মত। স্পিনোজা বলেন, ভালো খাদ্য-বস্তু পেট ভরে আর ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। আর দেকার্তে বলছেন, ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সাথে কথা বলা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম এক পৃষ্ঠপোষক নেপোলিয়ান বলেন, অন্তত ৬০ হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। জন মেকলে বলেন, প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় বসবাস করব তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়তে ভালোবাসে না। নর্মান মেলর বলেন, আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়। এ সব উক্তি থেকে বইয়ের গুরুত্বটা সমঝে নিতে পারা যায়। আর তাই বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রতিবছর রেখে যায় নতুন প্রাণের ছোঁয়া।
বইমেলার প্রভাব নিয়ে সাহিত্যিক নাসরিন জাহান উক্তি করেছেন, 'আমার বেড়ে ওঠার সময় থেকেই শুনে এসেছি আমাদের ভাষা, একুশের সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এ সব হারিয়ে যাবে। কিন্তু এখন সময় বলছে উল্টো কথা। এ সবের কিছুই হারায়নি। বরং আমরা এ সবের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করছি। আমি আশাবাদী মানুষ। এখন গ্রন্থমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারি বা অন্য কোনো জাতীয় দিন নিয়ে প্রজন্মের মধ্যে যে ধরনের আবেগ দেখি তা থেকে বলতে পারি, একুশের চেতনা আরও প্রবলভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে। আজকে শাহবাগে প্রজন্মের যে জাগরণ তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের কিছুই শোনেনি পর্যন্ত। কিন্তু নিজেদের বোধ তাদের এই জায়গায় টেনে এনেছে। সুতরাং যতদিন যাবে, প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাবে আমাদের চেতনার জায়গাটিও ততটাই দৃঢ় হবে। একুশ তার স্বরূপে বার বার আসবে তারুণ্যের জয়গান গাইতে গাইতে।'
অপরদিকে হরিশংকর জলদাসের মত, 'একুশ আমাদের সংস্কৃতিতে, মননে, গড়নে ক্রিয়াশীল। আমি মনে করি আমাদের বাঙালির অগ্রযাত্রায় একুশ ছিল প্রথম সোপান। এই সোপানে পা দিয়ে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পথ চলছি। আর শতাব্দীর পর শতাব্দীতে আমাদের অগ্রযাত্রায় এটির মর্যাদা, একুশের আবেদন কখনও ক্ষুণ্ন হবে না। আমি মনে করি ভবিষ্যতে এ দেশে আরও অগ্রসরমান, সংস্কৃতিমনা, উন্নত মানুষ আসবেন। তাদের কাছেও একুশের মর্যাদা থাকবে অটুট। আমাদের স্বাধীনতা ও বোধে যদি না কখনও অন্ধকার নামে, এই চেতনাও কখনও হারাবে না। এই চেতনাকে ধারণ করেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আরও উচ্চতার দিকে যাবে।' এ সব কথার সমূহ সত্যতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় বাংলা একাডেমির বইমেলা।
এই বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশের চেতনা এবং একুশের গ্রন্থমেলা সম্মিলিতভাবে আজ বাঙালির জীবনে অপরিহার্য অংশ। দিন দিন এ মেলা ব্যাপক জনগণের মাঝে দৃঢ় ভিত্তি পাচ্ছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এর ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পাবে। একুশের বইমেলাকে রক্ষা করা এবং এগিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা বার বার উজ্জীবিত হব ভাষাপ্রেমে, দেশপ্রেমে।
এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে, একুশের বইমেলা আমাদের আবেগের মেলা। ভালোবাসার মেলা। বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকেই মেলা হয়ে আসছে। আর সব মেলার মধ্যে বইমেলা হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়োজন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলায় গেলে মনটা কেন জানি শীতল হয়ে যায়। সেখানে গেলে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ বইকে কতটা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। প্রতিদিন হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় একাডেমি চত্বর। এবারও মুখরিত হবে। নজরুল মঞ্চে প্রতিদিন মোড়ক উন্মোচিত হবে নতুন বইয়ের। দেশের প্রথিতযশা লেখক-বুদ্ধিজীবীদের পদধূলিতে ধন্য হবে মেলা প্রাঙ্গণ।
এই মেলার পথিকৃৎ হিসেবে যার নাম সবার আগে আসে তিনি হলেন মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা। তিনিই প্রথম তার প্রকাশনা সংস্থার বই মাটিতে চট বিছিয়ে বিক্রি শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির কাছে বই বিক্রির অনুমতি চান এবং অনুমতি লাভ করেন। তখন থেকে বাংলা একাডেমিতে একুশের অনুষ্ঠানমালার ব্যাপ্তি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক নতুন মাত্রা লাভ করে। ১৯৭৮ সালে সরকার একে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থমেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য সরকারিভাবে আইন পাস করা হয় এবং নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ সেই সময় থেকে আজ অবধি চলছে তার পথচলা। চিত্তরঞ্জন সাহার স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলা একাডেমি ২০১০ সালে প্রবর্তন করে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার। সেরা গ্রন্থের প্রকাশককে দেওয়া হয় এ পুরস্কার।
বাংলা একাডেমির আয়োজনে এ বইমেলা দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পক্ষে বিশেষ অবদান রেখে চলছে। আর এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে যিনি প্রথম স্বপ্নের জাল বোনেন, স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন, তিনি হলেন সর্বজনস্বীকৃত পণ্ডিত বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি চেয়েছেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যা প্রকৃত অর্থেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাংলা একাডেমি প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকাশক, লেখকদের নিয়ে বাংলা একাডেমির নিরন্তর প্রচেষ্টা বইমেলাকে সৃষ্টি ও নান্দনিকতার সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করার প্রত্যয় আমাদের মুগ্ধ করে। যার ফলশ্রুতিতে বইমেলা শুধুমাত্র ক্রেতা-পাঠকেরই সমাগমের বাণিজ্যিক মেলা নয়; বরং এই মেলা লেখক-পাঠক, প্রকাশক-ক্রেতা-দর্শক এবং মিডিয়ার সাহচর্যে সর্বোতভাবে একটি জাতীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়। কেবল লেখক-প্রকাশকই নয়, পাঠক ও সাধারণ মানুষের প্রতীক্ষার বিষয় এ বইমেলা।
দেশের অধিকাংশ প্রকাশক-লেখক সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকেন বাংলা একাডেমির এই মেলাকে কেন্দ্র করে। প্রকাশকরা বিনিয়োগ করার জন্যও এই সময়টিকেই একমাত্র উপযোগী সময় হিসেবে বেছে নেন। ফলে দেখা যায় মেলার শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নতুন বই আসতে থাকে। আর শেষ দিকে যে সব লেখকের বই আসে তাদের মাঝে হতাশামিশ্রিত ক্ষীণ উত্তেজনা কাজ করে। নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়।
যে সব পাঠক একবারই মেলায় যান এবং যদি তা প্রথম দিকে হয়, তাহলে অনিবার্যভাবে তিনি হয়ত অনেক ভালো প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। ব্যস্ততার কারণে মানুষ এত সময় পায় না যে দু-চার দিন মেলায় গিয়ে বই কিনবেন। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় নতুন বই প্রকাশের প্রচলন কম থাকার কারণে পাঠকরাও মনস্তাত্বিকভাবে বইমেলাকেন্দ্রিক হতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রকৃতপক্ষেই এই মেলা আমাদের জাতীয় জীবনে যথেষ্ট প্রভাব রেখে চলেছে। এই সত্য শুধু আমরা নই; বিদেশিরাও স্বীকার করে নিচ্ছেন। এমনই একজন বিদেশির বক্তব্য দিয়েই এ নিবন্ধের ইতি টানছি। আর সেই আলোচিত বিদেশি হলেন উইলিয়াম রাদিচে। তিনি ব্রিটিশ কবি, অনুবাদক ও বাংলা সাহিত্যের গবেষক। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘এখন থেকে ৪৩ বছর আগের কথা। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের কথা। তখন আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করছি। তখনই প্রথমবারের মতো আমি বাংলা বইমেলা, ভাষা ও সাহিত্যের প্রেমে পড়ি। তখনই জানতে পারি এ দেশের মুক্তি সংগ্রামের কথা, মাতৃভাষার জন্য আন্দোলনের কথা। ... বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও সুগভীর হয়েছে। এ দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি- ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও এই অমর একুশে বইমেলা একই সূত্রে গাঁথা। ভাষা আন্দোলন না থাকলে স্বাধীনতা হতো না, স্বাধীনতা না হলে বইমেলা হতো না। আর বইমেলা না হলে এত মানুষের এই যে প্রাণের স্পন্দনও পাওয়া হতো না।’
লেখক : প্রাবন্ধিক ও আলোচক।