শামসুল হক
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার মাইঠান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রথম সারির নেতা। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে তার অবদান রয়েছে।
১৯৪৩ সালের শেষ দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আবুল হাশিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীরা প্রায় সকলেই জয়লাভ করেন। ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ শতকরা ৯৭ ভাগ আসনেই জয়লাভ করে। ওই সময় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্মিশিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুল হক। এ সব বিবেচনায় পাকিস্তান সৃষ্টিতে শামসুল হকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া সিলেটকে পাকিস্তানভুক্ত করার গণভোটে তার অবদান রয়েছে।
নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ক্ষমতাসীনদের পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর প্রতিবিধানে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ১৫০নং মোগলটুলির অফিসে শামসুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ এক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। পরে আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, মিসেস আনোয়ারা খাতুন ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল মাওলানা আকরম খানের সঙ্গে দেখা করেন মুসলিম লীগে সদস্য হওয়ার রশিদ বই পাওয়ার জন্য; কিন্তু কোনো লাভ হয় না। আতাউর রহমান খান ও আনোয়ারা খাতুন একই উদ্দেশ্যে করাচি গিয়ে মুসলিম লীগের সংগঠক চৌধুরী খালেকুজ্জামানের সঙ্গেও দেখা করেন কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ফলে কর্মীরা নতুন সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন থেকে ২৪ জুন ঢাকা রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ছিলেন এই দলের সভাপতি। শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে টাঙ্গাইলের দক্ষিণ মুসলিম কেন্দ্র থেকে মওলানা ভাসানীর সদস্য পদ বাতিল ঘোষণা এবং উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এই উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী। শামসুল হক তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রথম মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা সারা প্রদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেদিন সচিবালয়, নীলক্ষেত ও হাইকোর্টের সামনে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ঘটে। বহু ছাত্র আহত এবং গ্রেফতার হন। যে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সেদিন গ্রেফতার হন তাদের মাঝে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ছাত্রদের সভার শুরুতে শামসুল হক সেখানে উপস্থিত হন। তিনি ছাত্রদের বোঝাতে চেষ্টা করেন ওই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়ার পরিণতি- যা ভবিষ্যৎ আন্দোলন ও অন্যান্য কাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। কিন্তু ছাত্ররা সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির পর সরকার মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আবুল হাশিম, মনোরঞ্জন ধর, শামসুল হকসহ কয়েকজনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। ১৯৫৩ সালে শরীর ও মানসিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি মুক্তি পান। ওই সময়ই তাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৬৪ সাল পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্যহীন শামসুল হককে পথে পথে ঘুরতে দেখেছেন অনেকেই। তারপর হঠাৎ তিনি নিখোঁজ হন। এই নেতার নিখোঁজ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে রহস্যের সৃষ্টি হয়।
২০০৭ সালে তার নিখোঁজ রহস্য উন্মোচিত হয়। বলা হয়ে থাকে, ১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে জোকারচর গ্রামের মহিউদ্দিন আনসারী (তৎকালীন নামকরা কংগ্রেস নেতা) কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে কোনো এক স্থান থেকে শামসুল হককে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন শামসুল হক শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। মহিউদ্দিন আনসারীর বাড়িতে ৭ দিন থাকার পর তার হঠাৎ খুব জ্বর হয়। স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক শুকলাল দাস তার চিকিৎসা করেন। প্রচণ্ড জ্বরে শামসুল হক কোনো এক শনিবার (মাসের নাম অজানা) দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে মারা যান।
(দ্য রিপোর্ট/ওএস/ডব্লিউএস/জামান/ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৪)