ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির আন্দোলন
নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা
ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন কর্মসূচি পালনের কারণে প্রায় চার লাখ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন থেকে চার মাস নষ্ট হওয়ার পরও দাবি পূরণ হয়নি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের প্রতি ক্ষোভ নিয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজর) করার প্রতিবাদে এবং পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের শতভাগ বৃত্তি প্রদান ও বৃত্তির টাকা বাড়ানোর দাবিতে গত বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নানারকম আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন কর্মসূচি পালনের কারণে দেশের ৪৯টি সরকারি ও ৩৫৭টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের চার লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন থেকে চার মাস নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
আন্দোলন করে কোনো লাভ হয়নি মন্তব্য করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে আমাদের জীবন থেকে চারটি মাস নষ্ট হয়েছে আর নেতাদের পকেট ভারী হয়েছে। এখন তারা আমাদের কোনো খোঁজও রাখেন না। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে ১৫ দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন নেতারা। কিন্তু এখনও আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। এরই মধ্যে আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে এখন শেষ হওয়ার পথে।’
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদমর্যাদা বৃদ্ধির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে একাধিক পেজ খোলেন শিক্ষার্থীরা। এ সব পেজ গত এক মাস নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দাবি পূরণ না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা নানাভাবে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করো, করতে হবে’ নামের এক ফেসবুক পেজে গত ৮ জানুয়ারি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘পরীক্ষার দিন পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেও কেউ স্পষ্টত জানতাম না দুই দফা কী, DEB/বাকাছাপ কী? জানতাম শিক্ষকদের বেতন ও ছাত্রদের ইন্টার্নি ভাতায় ঊনিশ-বিশ হয়েছে মর্মে গত সাড়ে পাঁচ বছর যাবৎ শিক্ষকরা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। মাঝেমধ্যে আমাদেরও গাড়িভর্তি করে প্রেস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হতো।… ভাইয়েরা আমার, এভাবেই ছাত্রদের ব্যবহার করেছে সেই কুচক্রী পেশাজীবী শিক্ষক জনতা। সাড়ে পাঁচ বছরে যা পারেনি তা একদিনে করার ব্লু-প্ল্যান করেছিল তারা। অনুভূতি ভোঁতা করার সুযোগ নেই। নির্বিচারে মার খেয়েছেন নিরপরাধ ছাত্রছাত্রীরা। রাজপথে মার খাবে ছাত্রছাত্রীরা, ফায়দা লুটবে পেশাজীবী শিক্ষক জনতা।’
‘বাংলাদেশ কারিগরি স্বেচ্ছাসেবক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নামের একটি ফেসবুক পেজে গত ৯ জানুয়ারি সাগর নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘কোনো প্রতারণায় কান দেবেন না। নাটকীয়ভাবে যারা গেজেট পাসের কথা বলবে তারা মিথ্যাবাদী। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ২ দফা সংক্রান্ত গেজেট সংশোধন করা হয়নি।’
একই ফেসবুক পেজে গত ১ জানুয়ারি এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘একটি গেজেট পাস করতে কয় বছর লাগে সে সম্পর্কে এই মূর্খের দলেরা কিছুই জানেনা, তবু ফাও ফাও চিল্লায়। বড়লোকের পোলারা পরীক্ষা দিলে দাও না দিলে না দাও… তোমাদের বাবার মত অপথ-কুপথের টাকা আমাদের বাবার নাই। পলিটেকনিকের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলছি, যে পথে ধোঁকা খেয়েছো সে পথ আর মাড়িওনা।’
ভবিষ্যতে আর আন্দোলন করতে হবে না জানিয়ে বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র পরিষদের (বাকাছাপ) আহ্বায়ক জাকির হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের দাবি পূরণের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশ হয়ে গেছে। এখন শুধু ছাপানোর কাজ বাকি।’
দাবি পূরণে দৃশ্যমান কোনো সফলতা নেই জানিয়ে বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির (বাপশিস) সভাপতি মো. ইদ্রিস আলী মঙ্গলবার রাতে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গেজেট সংশোধনের মাধ্যমে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদকে সুপারভাইজর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। ২০১১ সালে বিষয়টি আমাদের গোচরে আসে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আমরা আন্দোলন শুরু করি। আশা করি খুব দ্রুতই আমাদের দাবি বাস্তবায়িত হবে।’
আন্দোলনকে পুঁজি করে অনেকের টাকা কামানোর অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে চার মাস নষ্ট হয়ে গেছে, এটি ঠিক। তবে কাউকে আন্দোলন করতে বাধ্য করা হয়নি। আমারও নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে আন্দোলন করেছি।’
দাবি পূরণ না হলে আবারও আন্দোলনে যাবেন জানিয়ে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পেশাজীবী-ছাত্র-শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব খন্দকার মাইনুর রহমান মঙ্গলবার রাতে কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) ভবনে পরিষদের কার্যালয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছি আমাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে। গত ২০ অক্টোবর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভ্যাটিংয়ের জন্য পাঠিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ শেষ হলে এটি আবার গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এটি ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে পাঠাবে।’
প্রকাশিত গেজেটে আপনাদের সব দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে।’
গেজেট প্রকাশের এ বিষয়টি সব শিক্ষার্থী জানেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে কিনা তা জানি না। তবে নেতারা জানেন।’
আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে চার মাস নষ্ট হলো কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে দাবি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তা হয়নি-এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আন্দোলন করলে কিছুটা ক্ষতি তো হবেই।’
(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এইচএসএম/আরকে/জামান/ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৪)