দেশে পানির স্তর নামছে
খাত ভিত্তিক পরিকল্পনায় ১০ ভাগ অর্থেরও যোগান নেই
শুষ্ক মৌসুম আসতে না আসতেই ঢাকা মহানগরসহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশের ৩০ ভাগ স্থানে পানির স্তর অতিমাত্রায় নামতে শুরু করেছে। এদিকে খাত ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্লান) চাহিদার ১০ ভাগ অর্থেরও যোগান নেই বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
আবহাওয়াবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, নদী শাসনের জন্য ফারাক্কাসহ অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ও অপচয়ের কারণে পানির স্তরের এই অবনমন ত্বরান্বিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড়। আর এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা খরাপ্রবণ অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার তেজগাঁওয়ের হরিরামপুরে পানির স্তর ৪২৬ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১৯৮৭ সালে এখানে পানির স্তর ছিল ৩০ ফুট নিচে। একইভাবে ঢাকার দক্ষিণ খান, মাতুয়াইল ও জিঞ্জিরাসহ দেশের ৪ হাজার ৭৭৫টি স্থানে পানির স্তর নেমে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ এ সব স্থানকে ১৯৮৬ সাল থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখে সমীক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, শহর এলাকায় বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে পানির স্তর নেমেছে কম। মধুপুরের গড় ও বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর তুলনামূলকভাবে অন্যান্য গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বেশি নেমেছে।
১৯৯৫ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর পরিচালিত এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ধারণা করা হয়েছিল, ২০১০ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ স্থানে পানির স্তর নেমে গেলে সাধারণ (নাম্বার সিক্স) নলকূপ অকেজো হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কেন হয়নি এ প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, সবক্ষেত্রে এ ধারণা ঠিক হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। দেশে শতকরা ১৮ থেকে ২০ ভাগ এলাকার নলকূপ সমস্যার মধ্যে আছে বলে জানালেন তিনি।
এ বিষয়ে সরকার ইতোমধ্যে পল্লী এলাকায় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে লাগসই হ্যান্ডপাম্প (হস্তচালিত নলকূপ) এর ব্যবস্থা করেছে। সমস্যাগ্রস্ত এ সব স্থানে তারাপাম্প বা তারা ডেভ পাম্প প্রচলন করা হয়েছে। এ ছাড়া সমস্যা মোকাবেলার জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল আরও নতুন নতুন উন্নত মানের পাম্প প্রচলনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের মোট ১৩ লাখ পাম্পের মধ্যে ৫০ হাজার অর্থাৎ শতকরা ৪ ভাগ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত এ সব পাম্প বছরে কোথাও কোথাও ৩ মাস, কোথাও ২ মাস এবং কোথাও ১ মাস অকেজো হয়ে পড়ে থাকে।
পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সরবরাহ ব্যবস্থাকে দায়ী করা হলেও মানতে নারাজ এই বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ম. নুরুজ্জামান। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, সারা দেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের ওপর ন্যস্ত। আর এই বিভাগের একমাত্র সরকারি সংস্থা হিসেবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার যাবতীয় দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে আসছে ।
ম. নুরুজ্জামান আরও বলেন, ভূগর্ভস্থই হোক আর উপরোস্থই হোক সবকিছুরই একটা সীমা আছে। অতিরিক্ত পানি উঠালে স্তরগুলোতে (লেয়ার ) ওয়াটার মাইনিং হয়। ওই লেয়ারে আর পানি রিচার্জ হয় না। তাই ওই লেয়ার কার্যকর থাকে না, অকেজো হয়ে পড়ে। খাওয়া ও কৃষি কাজের জন্য খুব সামান্য পরিমাণ পানি অর্থাৎ শতকরা ৪ ভাগ থেকে ৭-৮ ভাগ পানি ব্যবহৃত হয়।
শহর এলাকায় কোনো আইন মেনে বাড়ি ঘর করা হচ্ছে না। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ৪০ ভাগ জায়গা খালি রেখে বাড়ি তৈরি করার কথা থাকলেও তা মানা হয় না। মাটির নিচে পানি যাওয়ার জন্য শতকরা ৪০ ভাগ জায়গা খালি রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা। বাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে পুরো শহরই পাকা করে ফেলা হয়েছে। পানি মাটির নিচে যেতে পারছে না। রিচার্জ হতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই ওয়াটার লেভেল নিচে নেমে যাবে। বাস্তবে তাই হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের পরিকল্পনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ম. গোলাম মুকতাদির বলেন, কৃষিতে যথেচ্ছ না করে হিসেব মতো ব্যবহার করলে গ্রামাঞ্চলে পানির স্তর নেমে যাওয়ার সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। শহরাঞ্চলে বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধিমালা মেনে চললে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
প্রকৌশলী গোলাম মুক্তাদির আরও বলেন, এ কথা সর্বজনবিদিত পৃথিবীতে পরবর্তী মহাযুদ্ধ হবে পানির জন্য। কথার যথার্থতা- এই সেক্টরে কাজ না করলে বুঝতে পারতাম না। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যে, প্রতি ফোঁটা পানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সে দিক থেকে আমরা অনেক ভাগ্যবান। এখানে মাটির নিচেই পানি উত্তোলনযোগ্য লেয়ার আছে এবং সহজেই এ পানি উত্তোলন করা যায়। আবার বন্যার সময় সারাদেশ পানিতে প্লাবিত হয়। ফলে পানির পরিমাণগত দিক থেকেও এ দেশ অনেক ভাগ্যবান।
কিন্তু পানযোগ্য পানির দিক থেকে এ দেশের মানুষ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আর্সেনিক, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজসহ অন্যান্য রাসায়নিক কারণে এখানকার বিভিন্ন এলাকার পানি পানের যোগ্য থাকছে না।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া দেশের একটি বড় অংশে পানির স্থিতিতল ( ওয়াটার লেভেল) নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সহজ পদ্ধতিতে পানি উত্তোলন করা সম্ভবপর হচ্ছে না। সমুদ্রবর্তী উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে ও এই লবণাক্ততা উপকূল এলাকা থেকে উপরের দিকে উঠে আসছে। অনেক স্থানে পানির লেয়ারযুক্ত স্তর না থাকা বা পাথুরে স্তর থাকার কারণে সে সব স্থানে পানি উত্তোলন করা সম্ভব হয় না।
প্রকৌশলী মুক্তাদির বলেন, এ সকল সমস্যা মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের বিকল্প পানির উৎস স্থাপন বা আর্সেনিক পরিশোধন ব্যবস্থা স্থাপন করা হচ্ছে। যদিও এ সকল বিকল্প ব্যবস্থার মেরামত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা একটু জটিল বিধায় এর জন্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
এ ছাড়া লবণাক্ত এলাকায় বিভিন্ন কারিগরি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন পাথুরে এলাকায় আরও গভীরে খননের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় আর্সেনিক মিটিগেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। তবে সরকার ও দাতা সংস্থার অনুমোদিত সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্লান মোতাবেক প্রয়োজনীয় আর্থিক চাহিদার (২০১০-১১ অর্থবছরের ৩৮ হাজার কোটি টাকা) মাত্র ১০ শতাংশও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দাতা সংস্থাসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
(দ্য রিপোর্ট/এম/এইচএসএম/আরকে/এএল/ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৪ )