দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভারত বিভাগের আগেই রাষ্ট্রভাষার দাবিটি আলোচনায় আসে। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেই প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৯ মে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নিখিল ভারত মোছলেম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মোছলেমিনের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ প্রদান প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হইবে।’

সর্বপ্রথম পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে এর প্রতিবাদ করেন লেখক ও সাংবাদিক আবদুল হক (১০ অক্টোবর ১৯১৮-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)। ওই বছরের ২২ ও ২৯ জুন দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে দুই কিস্তির একটি প্রবন্ধ লিখেন। ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি লেখেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামের আরেকটি প্রবন্ধ। ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ নামে এই বিষয়ে আবদুল হক তৃতীয় প্রবন্ধটি লিখেন ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায়। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার ৩ আগস্ট ১৯৪৭ সংখ্যায় চতুর্থ প্রবন্ধটি লিখেন মিসেস এম. হক ছদ্মনামে। ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার লেখালেখি নিয়ে মুক্তধারা ১৯৭৬ সালে প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। বইটির শিরোনাম- ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব।

পাকিস্তানের জনসংখ্যার হিসাবের দিকে তাকালে তার যুক্তি বোঝা যায়। ব্রিটিশ ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯০ লাখ। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী ছিল ৪ কোটি ৪০ লাখ। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। এ সব লেখায় আবদুল হক জনসংখ্যা, ভূগোল ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে দেখিয়ে দেন কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয়, বাংলা হবে। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘যে ভাষাকেই আমরা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে, কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে সব থেকে বেশি সুবিধা হবে, কোন ভাষায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক কথা বলে, পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাষা কোনটি, কোন ভাষায় সব থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, এবং কোন ভাষা ভাব প্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশি উপযোগী।’

তিনি পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পাঁচটি ভাষার উদাহরণ দিয়ে দেখান সেখানে উর্দু নেই। যেমন- বেলুচি, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ও বাংলা। পাকিস্তানের দুই অংশে উর্দু ব্যবহার হলেও কোনো প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু নয়। তিনি লিখেন, ‘সিলেটের গণভোটে আমাদের জয় হলে এবং সীমা নির্ধারণ কমিশনের রায়ের ফলে আপাত নির্দিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানের সংলগ্ন-প্রধান অঞ্চলগুলো এর সঙ্গে সংযুক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ কোটির কিছু বেশি। এই পাঁচ কোটির প্রায় সকলেই বাংলাভাষী। পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসংখ্যা কিছু কমবেশি তিন কোটি, এবং ভাষা হিসেবে এই তিন কোটি লোকও আবার প্রধান চারভাবে বিভক্ত।’ এ সব কিছু বিবেচনা করলে পাকিস্তানের সব থেকে বেশি লোক কথা বলে বাংলা ভাষায়। তাই রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি সবচেয়ে বেশি বাংলার।

সাহিত্যচর্চার দিক থেকেও তিনি বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের মতো ভারতের আর কোনো সাহিত্যই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারেনি; পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যগুলোর পর্যায়ে ভারতের একমাত্র বাংলা সাহিত্যই স্থান পেতে পারে। যেকোনো সাহিত্যের বিকাশ কেবল প্রতিভা, সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে না, খানিকটা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর নিভর করে। ভারতের বা পাকিস্তানের যেকোনো সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে প্রমাণিত হয় ভারতের তথা পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা হচ্ছে বাংলা।’

এ ছাড়া উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পাকিস্তানের আট কোটি লোকের জন্য এমন একটা ভাষা নেওয়া হবে যা তাদের মাতৃভাষা নয়। উর্দুভাষী না হওয়ার কারণে পাঁচ কোটি লোক সরাসরি চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। কেবলমাত্র উর্দু জানার জন্য একজন মেট্রিক পাস উর্দুভাষীও তার চেয়ে চাকরির অধিকতর উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।

তিনি আরও উল্লেখ করেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির মধ্যে কোনো বিদ্বেষ বা বিতৃষ্ণা নেই। তিনি বলেন, `ভারতে ব্রিটিশ আমলে যারা স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তারা উর্দুতে তাদের বক্তব্য বলে গেছেন; শিবলী নোমানী, সৈয়দ আহমদ, হালী, ইকবাল-এদের সাধনায় উর্দু ভাষায় একটা বিরাট সাহিত্য গড়ে উঠেছে। অতএব, উর্দু সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাই আমাদের স্বাভাবিক। কিন্তু তবু বর্ণীত কারণসমূহের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত নয়, এবং তা করলে পাকিস্তানের প্রায় সব নাগরিকের ওপরই অবিচার করা হবে, শুধু সেই কথাই আমার বক্তব্য।'

পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা একই ধরনের যুক্তি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না উল্লেখ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘‘আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।’ সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ‘উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ 'নিরক্ষর' এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই 'অনুপযুক্ত' হয়ে পড়বে।’’

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৪)