গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে না ছাত্রলীগ
বাহরাম খান ও জাহিদ হাসান, দ্য রিপোর্ট : বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বশেষ কাউন্সিল হয় ২০১১ সালে ১০ এবং ১১ জুলাই। ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্বে আসেন এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সিদ্দিকী নাজমুল আলম। গঠণতন্ত্র অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১১ জুলাইয়ের মধ্যে কাউন্সিল হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা হয়নি। উল্টো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ বাড়ানোর আনুষ্ঠানিকতাটুকুও সম্পন্ন করেনি ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটি।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১(খ) উপধারা অনুযায়ী ‘কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল ২ বৎসর। উপরিউক্ত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে।’ বর্তমান কমিটির আগের কমিটি থেকে এই নিয়ম চালু হয় ছাত্রলীগে। কিন্তু বয়সের গণ্ডিতে বাধা প্রথম কমিটিই (রিপন-রোটন) সঠিক সময়ে কাউন্সিল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের দেখানো পথই অনুসরণ করছে বর্তমান কমিটি।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেষ্টা করলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়েরই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। সংগঠনটির সহ-সভাপতি আলী আশরাফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ছাত্রলীগ বয়সের গণ্ডি বেধে দেওয়ার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে যে তারুণ্য এনেছিল তা সময় মতো কাউন্সিল না হওয়ায় নষ্ট হতে বসেছে। একদিকে আপনি বয়সের গণ্ডি বেধে রাখবেন, অন্যদিকে ঠিক সময়ে কাউন্সিল করবেন না, তাহলে দীর্ঘদিন যারা রাজনীতি করছেন তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার কি সুযোগ থাকবে?
আপনারা কাউন্সিলের উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে আশরাফ বলেন, এটা তো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক উদ্যোগ নিতে পারেন। আমাদের কিছু করার নেই।
সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের ১১(গ) ধারা অনুযায়ী ‘বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল ৩ মাস বৃদ্ধি করা যাবে। উক্ত সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্যবৃন্দ যোগ দিবেন।’
গঠনতন্ত্রের ১৩ ধারা মোতাবেক ‘প্রতি দুই বৎসরে একবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। তবে ২১ দিনের নোটিশে প্রয়োজন বোধে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা যায়।’ বর্তমান কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণের পর ছয় মাসের বেশি হয়ে গেলেও ‘বিশেষ’ বা ‘জরুরি’ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো বর্ধিত সভার আহ্বান করা হয়নি।
ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান কমিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠন হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী (দুই বছরের মধ্যে) পরবর্তী কাউন্সিল প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সময় মতো কাউন্সিল না হওয়ায় নেতৃত্ব প্রত্যাশীরা হতাশ।
তাদের মতে, কেন্দ্রীয় কমিটি যখন গঠনতন্ত্র মেনে চলবে না তখন বিভিন্ন ইউনিটগুলোও কেন্দ্রকে অবহেলা করার সুযোগ পায়। যে কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের নৈরাজ্যের বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি থাকলেও প্রায় সময়েই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। এ সব সংঘর্ষে একাধিক প্রাণ হারিয়েছে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ইউনিটে। আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে টেন্ডারবাজি এবং নারীঘটিত বিষয় নিয়েও।
এ সব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জয়দেব নন্দী দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ সব বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললেই ভাল হয়।
নিয়ম আছে প্রয়োগ নেই
নিয়ম-কানুনে ফিটফাট। আছে অনুমোদিত গঠনতন্ত্র। এ সবের কোনো কার্যকারিতা থাকছে না ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে। বয়স ক্রাইটেরিয়ায় গঠিত প্রথম কমিটিই (রিপন-রোটন) ছাত্রলীগের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের (প্রায় অর্ধযুগ) কমিটি হিসেবে বিদায় নিয়েছিল। অবশ্য ঐ কমিটির সময় সেনাসমর্থিত তত্ত্বধায়ক সরকারের আমলে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকায় তারা একটি বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমান কমিটির ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিষয় উপস্থিত না থাকলেও সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়নি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলের পর তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে চারমাস পর ২৫১ সদস্যের জায়গায় ২২১ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করেছিলেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে। ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল বর্তমান কমিটির চাকরিপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে পুনর্গঠন করা হয়। এই ক্ষেত্রেও তারা ছাত্রলীগে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত সভ্যর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ নেতা বানিয়ে।
সময় মতো কাউন্সিল না হওয়ার বিষয়ে অনেক নেতার মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও পরবর্তী সময়ে পদ পেতে সমস্যা হতে পারে এমন আশঙ্কায় নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি নন কেউ। তাদের মতে, যারা পদ আঁকড়ে থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন তাদের সম্মান জানাতে চাই না, তারপরও অনিচ্ছাকৃতভাবে মুখ বুঝে সংগঠনে থাকতে হচ্ছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে আসা নেতৃত্ব যদি তার মেয়াদ পূর্ণ করার পর পরবর্তীদের নেতৃত্বের সুযোগ না করে দেন তাহলে বুঝতে হবে বর্তমান শীর্ষ নেতারা আমাদের বঞ্চিত করছেন।
এ বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
আলোচনায় ‘বয়স’
ছাত্রলীগের নেতৃত্ব, কাউন্সিলসহ সব ধরনের আলোচনার মূল বিষয় এখন বয়স। বয়সের বাধাধরা নিয়ম না থাকলে কাউন্সিল নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে এতটা উদ্বিগ্নতা থাকত না। আর এই বয়সকে কেন্দ্র করেই আগামী দিনের নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের মধ্যে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। একটি পক্ষ ঊনত্রিশ বছরের কাছাকাছি বয়স নিয়ে উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন গুণছেন। আরেকটি অংশ ফুরফুরে মেজাজে এই কমিটির দীর্ঘমেয়াদ কামনা করছেন। দ্বিতীয় অংশটির সুপ্ত বাসনা হচ্ছে কাউন্সিল অনুষ্ঠানে যত দেরি হবে ততই একের পর এক সিনিয়র নেতা বাদ পড়বেন। শীর্ষ নেতৃত্বে আসতে সুযোগ তৈরি হবে জুনিয়রদের।
এই সূক্ষ্ম হিসাবের মারপ্যাঁচে নতুন করে বিশৃঙ্খলা হতে পারে সংগঠনে। এর কারণ হিসেবে সংগঠণ সংশ্লিষ্টদের যুক্তি, কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের যোগ-বিয়োগ হলে সেখানে মূল নেতৃত্বে বাদপড়াদের ক্ষোভ থাকলেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু যারা কাউন্সিল পাওয়ার প্রাপ্য, তাদের যদি সময়ক্ষেপণের কারণে নেতৃত্বে আসার স্বপ্ন ভঙ্গ হয় তাহলে তারা সংগঠনে জটিলতা তৈরি করে নতুন বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারেন। যার নমুনা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা ছাত্রলীগের বিশৃঙ্খলার সর্বশেষ উদাহরণ।
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/জেএম/এএল/ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৪)