বকর হত্যাকারিদের অনেকে ছাত্রলীগের পদে
ঢাবি নিভৃতে কাঁদে তার স্মরণে
জাহিদ হাসান, দ্য রিপোর্ট : প্রচণ্ড আর্থিক অনটনের মধ্যেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন আবু বকর। ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। টিউশনি আর ভাইয়ের মুদি দোকানের অর্থে পড়াশোনার খরচ চালাতেন বকর। কিন্তু ছাত্রলীগের ‘সন্ত্রাসের’ জাঁতাকলে থেমে গেছে তার জীবনের লড়াই। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের শিকার হয়ে প্রাণ হারাতে হয় তাকে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে স্যার এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আবু বকর। টানা দুই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মেধাবী এই ছাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে নিহত আবু বকরের মৃত্যুর চার বছর পার হলেও বিচার হয়নি অপরাধীদের। জামিনে রয়েছেন কয়েক আসামি। মামলার আসামিরা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন জামিনে থাকা কয়েকজন।
আবু বকর সিদ্দিক হত্যা মামলায় ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর আগে শাহবাগ থানার দেওয়া অভিযোগপত্রে আটজনকে আসামি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ অভিযোগ গঠন করা হয়নি।
এর আগে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তখনকার হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান মোল্যা গ্রুপের সংঘর্ষের সময় তিনি আহত হন। মৃত্যুর দুই মাস পর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকরের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে প্রথম হয়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ১৪ মাস মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে ছাত্রলীগের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুককে প্রধান আসামি করে ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হলেও এ ঘটনার এখনও সুষ্ঠু বিচার হয়নি।
মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- এনামুল হক, মনসুর আহমেদ রনি, আবু জাফর মো. সালাম, মফিদুল ইসলাম খান, রকিব উদ্দিন, মেহেদী হাসান ও তৌহিদুল খান তুষার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসামিদের অধিকাংশই মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে হল ও ক্যাম্পাস ছেড়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন এখনও হলের বিভিন্ন রুমে অবস্থান করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ১০ ছাত্রকে নামমাত্র সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
বিচার দাবি পরিবারের
আবু বকরের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি তিনি। তারপরও রাজনীতির বলি তাকে হতে হয়েছে। ছয় ভাই বোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে চেয়েছিলেন আবু বকর।
আবু বকরের বড় ভাই আব্বাস আলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, এখন আর কী বলার আছে? ভাই তো গেল। শত কথা বলেও তো তাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। ভাইকে পড়তে পাঠিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের আশা-ভরসার প্রধান স্তম্ভ ছিল সে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির কলুষতা তাকে চিরতরে শেষ করে দিল।
আবু বকরের বাবা রুস্তম আলী এখনও সহজ হয়ে কথা বলতে পারেন না। শুধু বলেন, কোনোভাবে বেঁচে আছি। মা রাবেয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। সবারই দাবি, আবু বকরকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গেই একাডেমিক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার কোনো পুনরাবৃত্তি আমরা আশা করি না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। যারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছে।’
ঢাবি প্রক্টর এম আমজাদ আলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আদালত থেকে যদি কাউকে জামিন দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার থাকে না। তবে আমরা চেষ্টা করব যত দ্রুত সম্ভব আসামিদের বিচারকার্য শেষ করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা।’
হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আজিজুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত কেউ যদি হলে থেকে থাকে, তাহলে সে গোপনে থাকছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের হলে না থাকতে বলা হয়েছে। আমরা আবারও অভিযুক্তদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। কোনো অভিযুক্ত হলে থাকতে পারবে না।’
(দ্য রিপোর্ট/জেএইচ/এসবি/শাহ/ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৪)