‘নিয়ন্ত্রণহীন’ নিবন্ধনের সুযোগ থাকায় প্রতিমাসে গড়ে দেড় হাজার প্রাইভেটকার ঢুকছে রাজধানীতে। স্বল্পমূল্যের জ্বালানি সুবিধা থাকায় উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের ‘শখে’ পরিণত হয়েছে প্রাইভেটকার। আর মেগাসিটির দ্বারপ্রান্তে থাকা ঢাকার রাজপথ পুরোটাই দখলে নিয়েছে এ সব ব্যক্তিগত যান।

নগর ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাধীনতার পর দ্রুত নগরায়ণ ঘটে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও রাজধানীর মাস্টারপ্ল্যান, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ও পরিবহন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন না করায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠে ঢাকা। ফলে রাজধানীতে আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পাঞ্চলও গড়ে উঠেছে পাশাপাশি। আদর্শ একটি নগরের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ রাস্তা থাকার কথা থাকলেও ঢাকাতে আছে মাত্র ১৩ শতাংশ, যা কমতে কমতে বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে জনবহুল শহরটির গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করেই অপরিকল্পিতভাবে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে প্রাইভেটকারের।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজধানীতে অন্যান্য গণপরিবহনের মতো প্রাইভেটকারও সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) চালিত হওয়ায়, শুধুমাত্র জ্বালানি খরচ কম বলে ৮০ শতাংশ উচ্চবিত্ত পরিবার প্রাইভেটকার ব্যবহার করছে।

এদিকে রাজধানীতে যান চলাচলের ব্যাপারে কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রতিবছর দশ থেকে ১২ হাজার প্রাইভেটকার নিবন্ধন নিচ্ছে। সরকারি হিসাব মতে, ২০০৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ঢাকাতে প্রতিমাসে গড়ে দেড় হাজার প্রাইভেটকারের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অধিদফতরের (বিআরটিএ) হিসাবে মতে, ২০১৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা এক লাখ ৯০ হাজার ৫১৫টি। কিন্তু বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। অন্যদিকে সরকারি সংস্থা বিআরটিএ’র হিসাব মতে, রাজধানীতে চলছে প্রায় দুই হাজার অনিবন্ধিত প্রাইভেটকার।

বিআরটিএর হিসাব মতে, রাজধানীতে নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৫টি, যেখানে সমগ্র বাংলাদেশে রয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৮৪টি। রাজধানীতে নিবন্ধিত জিপ রয়েছে ৭২ হাজার ২৩০টি, ট্যাক্সিক্যাব ৩৬ হাজার ১১০টি, বাস ২০ হাজার ৩৯২টি, মিনিবাস ৯ হাজার ৮০৫টি, ট্রাক ৩৬ হাজার ৯৭২টি, অটোরিকশা ২০ হাজার ২৯১টি, মোটরসাইকেল ৩ লাখ ২ হাজার ১৮০টি। এ ছাড়া অন্যান্য নিবন্ধিত যান্ত্রিক পরিবহন রয়েছে ৫৯ হাজার ৩৩৩টি। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র ২০০৯ সালে ১০টি ট্যাক্সির নিবন্ধন দেওয়া হয়। বিআরটিএর হিসাব মতে, ২০০৩ সালে রাজধানীতে নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৮৬৬টি, যা গত ৯ বছরে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

সংস্থাটির দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৪ সালে প্রাইভেটকার নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৭৩৪টি, ২০০৫ সালে ৫ হাজার ৬৩৩টি, ২০০৬ সালে ৭ হাজার ৪০৩টি, ২০০৭ সালে ১০ হাজার ২৪৪টি, ২০০৮ সালে ১৩ হাজার ৭৪৯টি, ২০০৯ সালে ১৭ হাজার ৬৫৪টি, ২০১০ সালে ১৯ হাজার ৫৫৭টি, ২০১১ সালে ১১ হাজার ৪২৩টি, ২০১২ সালে ৮ হাজার ১৮৭টি ও অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত ৭ হাজার ৯০১টি প্রাইভেটকারের নিবন্ধন করা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সূত্রমতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিমাসে গড়ে দেড় হাজার করে প্রাইভেটকার নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। তবে তুলনামূলক বৃদ্ধি পায়নি গণপরিবহনের সংখ্যা। ২০০৩ সালে রাজধানীতে বাসের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬১৪টি, যা ৯ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৯২টিতে। তবে ফিটনেস না থাকার জন্য ডাম্পিং হওয়া বাসের সংখ্যা নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।

গবেষকদের মতে, আরামদায়ক ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না করায় রাজধানীতে গণপরিবহন সব শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া পরিকল্পিতভাবে রুট নির্ধারণ ও গণপরিবহনের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি।

এ ব্যাপারে কথা হলে পরিবহন বিষয়ক গবেষক মারুফ আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ট্রিপ জেনারেশন (তৈরি) হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৮ শতাংশ ট্রিপ সৃষ্টি হচ্ছে মাত্র ৩ থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। যদি অনুকূল ও বাধামুক্ত ফুটপাথের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই ৩৮ শতাংশ ট্রিপ মানুষ পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে করে যেতে পারতেন।’

রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার পরিকল্পনা মানা হয়নি দাবি করে মারুফ আহমেদ বলেন, ‘রাজধানীতে এখন পর্যন্ত যে কয়টি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশিই করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ রোড ধানমণ্ডি-ঝিগাতলা-সায়েন্সল্যাব-শাহবাগ হয়ে মতিঝিল-আরামবাগ পর্যন্ত একটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রুটে চলছে ৬টি কোম্পানির বাস। আবার মোহাম্মদপুর হয়ে আসাদগেট-শুক্রাবাদ-কলাবাগান-সায়েন্সল্যাব-শাহবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত আরেকটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এই রুটে বাস চলছে মাত্র একটি কোম্পানির। অন্য একটি রুট মোহাম্মদপুর-আসাদগেট-মানিক মিয়া এভিনিউ-ফার্মগেট-কারওয়ানবাজার হয়ে শাহবাগ-প্রেসক্লাব-মতিঝিল হয়ে যাত্রাবাড়ী-চিটাগং রোড পর্যন্ত একটি রুট গেছে, যে রুটে যাত্রী চলাচল অন্যান্য রুটের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে এই রুটে অফিসগামী লোকের যাতায়াত বেশি। কিন্তু এই রুটটিতেও রয়েছে মাত্র একটি লোকাল বাস সার্ভিস। আর এই বাস সার্ভিস নিয়েও অভিযোগ রয়েছে সাধারণ যাত্রীদের।’

মারুফ আহমেদ বলেন, ‘শুধু মোহাম্মদপুর নয়, রাজধানীতে অন্যান্য রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রেও কোনো সমীক্ষা চালানো হয়নি। অনেকটা রাজনৈতিকভাবে এ সব রুট নির্ধারণ করা হয়েছে।’

বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক সমীক্ষা অনুযায়ী জানা যায়, প্রাইভেটকার রাজধানীর মোট রাস্তার ৩৪ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। অথচ ট্রিপ জেনারেশনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে মাত্র ১২ শতাংশের মতো।

রাজধানীতে প্রাইভেটকারের অবাধ বিচরণ ও যত্রতত্র পার্কিংয়ের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গোলাম মর্তুজা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রাজধানীতে প্রাইভেটকারের অবাধ বিচরণ ও রাস্তার মাঝে পার্কিং করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাজধানীতে যানজট লেগে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘লক্ষ্য করলে দেখবেন, সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত রাজধানীতে বড় ধরনের যানজট দেখা যায়। এর কারণ এ সময়টা বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা আসা শুরু করে। দেখা যায়, মাত্র একটি শিশুকে স্কুলে পৌঁছে দিতে একটি প্রাইভেটকার ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রাইভেটকারটি বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত একটি ট্রিপ জেনারেট করছে। কিন্তু স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার পর হয় গাড়িটিকে রাস্তার পাশে পার্কিং করতে হচ্ছে অথবা বাড়িতে ফিরে যেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি ট্রিপ সৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু তা কোনো কাজে আসছে না। বরং এই ফাঁকা ট্রিপটার জন্য রাজধানীতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।’

পরিবহন বিশেষজ্ঞ মারুফ আহমেদ ও নগর পরিকল্পনাবিদ গোলাম মর্তুজার মতে, রাজধানীর স্কুল-কলেজগুলোতে ডোর-টু-ডোর আরামদায়ক বাস সার্ভিস চালু করা গেলে এবং অন্যান্য গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও যদি সেবার মান, নিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা যায়, তাহলে প্রাইভেটকারের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে।

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এসবি/এনআই/জামান/ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৪)