করাচি শিক্ষা সম্মেলন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রথমদিকেই বাংলাভাষীরা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। রাষ্ট্রীয় সবকিছুতে উর্দুর প্রাদুর্ভাব ছিল লক্ষণীয়। পাকিস্তানের খাম, পোস্টকার্ড, ডাকটিকেট, মানিঅর্ডার ফরম, রেলের টিকেট সবকিছুতে ছিল উর্দু ও ইংরেজি। কোথাও ছিল না বাংলা। ফলে নতুন রাষ্ট্রের শুরুতেই ভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। ক্ষোভের প্রথম প্রকাশ ঘটে সরকারি কর্মচারী ও ছাত্রদের মধ্যে।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে নীলক্ষেত ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীদের বড় একটি অংশ বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবিতে ব্যারাক প্রাঙ্গণেই বিক্ষোভ করে। তাদের স্লোগান ছিল- ‘সবকিছুতে বাংলা চাই, উর্দুর সঙ্গে বিরোধ নাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু বাংলা ভাই ভাই’ ইত্যাদি। এ নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বছরের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণাপত্র বিতর্ককে আরও উস্কে দেয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবল উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিবাদে ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত ও একেএম আহসান প্রমুখ।
ছাত্রসভার মূল দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি এবং পূর্ববঙ্গে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহনরূপে বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দান। সভা শেষে একটি মিছিল হয়। মিছিলটি সচিবালয়, মন্ত্রী ভবন ও মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ‘বর্ধমান হাউস’-এর সামনে প্রদক্ষিণ করে। মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর জুলুম চলবে না’ প্রভৃতি। এভাবে ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে এর প্রতিক্রিয়া হতে থাকে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও কলেজের ছাত্রাবাস ঘিরে ছাত্ররা সংগঠিত হতে থাকে।
এই আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল- এটি শুধু ছাত্র-শিক্ষক বা বুদ্ধিজীবীদের দাবি নয়। সরকারি কর্মচারীরা জড়িত থাকায় প্রথম থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ভিন্নমাত্রা নিয়ে শুরু হয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীরা এ তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। তারা আন্দোলনকারীদের মধ্যে ফাটাল ধরানোর চেষ্টা করে কিন্তু সে চেষ্টায় সফলতা পায়নি। তারা বুঝতে পারেনি অথবা বুঝেও না বুঝার অবস্থায় ছিল। কেননা, আন্দোলনটি শুধু ভাষাকেন্দ্রিক ছিল না। বরং এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল আর্থ-সামাজিকভাবে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়- পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয়ে সব উচ্চপদে আসীন ছিলেন অবাঙালি পাকিস্তানি। এ সময় বাংলাভাষী বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে ভাষা সমস্যা নিয়ে লিখতে থাকেন। এর মধ্যে ড. এনামুল হক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও কাজী মোতাহার হোসেনসহ আরও অনেকে ছিলেন।
আন্দোলনটি প্রথম থেকেই একটি সাংগঠনিক ভিত্তি লাভ করে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন। এর সদস্য ছিলেন আবুল কাসেম, মহম্মদ তোয়াহা, নঈমউদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, আবুল খায়ের, শওকত আলী, ফরিদ আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ আরও অনেকে। প্রথম আহ্বায়ক ভূঁইয়ার সময়কালে কমিটির সকল ধরনের কর্মকাণ্ড গোপনে পরিচালনা করা হতো।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও কলা অনুষদের সঙ্গে এক বৈঠকে দেশব্যাপী বাংলাকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার কথা আলোচনা করা হয়। বৈঠকে বাংলাকে শিক্ষার প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে এ সংগ্রাম পরিষদ আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূমিকা রাখে।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এইচএসএম/শাহ/ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৪)