দেশে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে : খালেদা
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে এ অবৈধ সরকার বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের অধিকার হরণ করেছে।’ সরকারকে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড চালাতে না দিলে দেশে তৃতীয় শক্তি ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে পারে।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক মাসের মধ্যে বিরোধী দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা ও গুম করেছে সরকার।’
গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা বলেন ১৯ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়া। এ সময় তিনি ফেব্রুয়ারিকে শোকের মাস আখ্যায়িত করে অমর ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া, হিন্দু সম্প্রদায়ের সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দেশের হিন্দুদের বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানান।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রকে হত্যা করে, একদলীয় ও একব্যক্তির স্বৈরশাসন জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। এটা করা হয়েছে কারসাজি ও জবরদস্তির মাধ্যমে। ইচ্ছেমতো সংবিধান বদল করে, সংবিধানের দোহাই দিয়ে, বিনাভোটে ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরা ক্ষমতা দখল করেছে। নির্বাচনকে জালিয়াতিপূর্ণ তামাশায় পরিণত করেছে। জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তিনশ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসন আওয়ামী লীগ ভোটের আগেই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল। বিএনপিকেও তারা ভাগ দিতে চেয়েছিল। আমরা আসন ভাগাভাগি চাইনি। চেয়েছি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারবে। তেমন নির্বাচন নিশ্চিত করতেই আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়েছিলাম। সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ দাবি কত সঠিক ছিল।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোট, অনুমোদন ও সমর্থন ছাড়া তামাশার সংসদ ও ক্ষমতা দখলকারী একটি অবৈধ সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকার ও সংসদ বৈধ জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত নয়। সংসদের নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সাজানো বিরোধী দলের নেতা, কেউই জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বেশির ভাগ মন্ত্রীই হয়েছেন ভোট ছাড়া। ইচ্ছেমাফিক রদবদল করা সংবিধানের ধুয়া তুলে, আইনের ফাঁকে এদেরকে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণার পর তাদের মুখে আর জনগণের কথা শোভা পায় না।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘১৯৭৫ সালে এরা গণতন্ত্র হত্যা করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল। তাদের দলের নেতাকে জনগণের ভোট ছাড়াই রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে ঘোষণা করেছিল; যেন তিনি নির্বাচিত। একই ধারায় এবার তারা ভোট ছাড়াই তামাশার সংসদ ও অবৈধ সরকার গঠন করেছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ এক সময় আন্দোলনের নামে যে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তা কারও অজানা নয়। চরম সুবিধাবাদী এই দলটি যখন যেটাই তাদের কাছে সুবিধাজনক মনে হয়, তারা তখন সেটাই বলে এবং করে। আবার সুবিধা না হলে, তারা এর চরম বিপরীত অবস্থান নিতেও সামান্যতম লজ্জাবোধ করে না।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্বলের প্রতিশোধ ভয়ঙ্কর। পরাজয়ের গ্লানি ভয়াবহ। অক্ষমতার জিঘাংসা মারাত্মক। সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন ও জনগণ বর্জিত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে অপরদিকে দলীয় সন্ত্রাসীদের সারাদেশে লেলিয়ে দিয়েছে জনগণ ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার এমন নিষ্ঠুর তাণ্ডব ও ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলের পৈশাচিক বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তালিকা করে বেছে বেছে খুন, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, আটক করে গুলি চালিয়ে বা নির্মম দৈহিক নির্যাতনে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তারা দেশকে পাইকারি হত্যাকাণ্ডের এক আতঙ্কিত জনপদে পরিণত করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় তিন শতাধিক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে খুন ও গুম করা হয়েছে। এদের নাম ও তালিকা বিএনপির হাতে আছে।’
খালেদা জিয়া অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘দলীয়করণ ও হীন রাজনৈতিক উদ্দেশে অপব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নৈতিক শক্তি ধ্বংস করে ঘাতক বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। বাইরের নির্দেশনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি দমন ও বিরোধী দল নির্মূলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সীমান্ত অরক্ষিত রেখে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের অসৎউদ্দেশে অপব্যবহার করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ও গুরুতর সন্ত্রাস দমনে আমরা র্যাব গঠন করেছিলাম। সেই জনপ্রিয় বাহিনীর সুনাম ধ্বংস করে এটিকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখার কার্যক্রম অপরাধ দমনের চেয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি দমনের কাজেই বেশি প্রয়োগ করা হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই নন, সাধারণ মানুষও আজ আক্রান্ত ও আতঙ্কিত। দেশজুড়ে এক চরম অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় কোনও বাহিনীর বিরুদ্ধে নন। এ গুলো জনগণের বাহিনী। কিন্তু অবৈধ সরকারের ক্ষমতা রক্ষায় তাদের আজ জনগণের প্রতিপক্ষে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নয়, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। খুন করছে, জখম করছে, অত্যাচার করছে, লুটপাট করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অত্যাচারে অংশ নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ ও মিছিল করতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ-র্যাব হামলা চালাচ্ছে। ঢাকায় বিরোধী দলের সমাবেশ, গণজমায়েত, জনসভা ও মিছিল করার অধিকার হরণ করা হয়েছে। জবরদস্তি ও ত্রাসের এই বেআইনি শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ বেশিদিন নীরব থাকবে না। আমরাও নিশ্চেষ্ট বসে থাকবো না।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আরএ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, সারোয়ারী রহমান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আব্দুল মঈন খান।
এ ছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শামছুজ্জামান দুদু, ফজলুর রহমান পটল, রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম-মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
১৯ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদ, খেলাফত মজলিশের সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর শুরা সদস্য অ্যাডভোকেট মশিউল আলম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) চেয়ারম্যান শফিউল আলম প্রধান, এনডিপির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মোর্তুজা, ডেমোক্রেটিক লীগ সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি ও লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এনডিএস/এমএআর/ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৪)