দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে তমুদ্দিন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত নেয়, ১১ মার্চ হবে দেশব্যাপী প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা দিবস। এ জন্য তারা অন্যান্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর ২ মার্চ দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এবারও আহ্বায়ক করা হয় তমুদ্দিন মজলিশের সদস্য শামসুল হককে। ১১ মার্চের কর্মসূচি ঠিক করার জন্য ৪, ৫ ও ১০ তারিখে বৈঠক হয়।

১১ মার্চ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসেন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। তারা গণপরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে অফিস বজর্নের আহ্বান করেন। এ ছাড়া নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, রমনা পোস্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং শুরু হয়। বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের আক্রমণে বহু নেতাকর্মী আহত হন। এর মধ্যে মহম্মদ তোয়াহাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন।

বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন। বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মো. নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দিন আহমদ। ধর্মঘট ১২ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত চলতে থাকে।

সরকারের অত্যাচারের মুখে আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভাষা আন্দোলন ঢাকার বাইরে রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, যশোর, খুলনা, দৌলতপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ভৈরব, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কায় পূ্র্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন শঙ্কিত হয়ে পড়েন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে তিনি সংগ্রাম পরিষদকে শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে আন্দোলন বন্ধ করার আহ্বান জানান। অনেক বাদ-বিবাদ আর দেন-দরবারের পর ১৫ মার্চ দুইপক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। সেই চুক্তিতে ৮টি দফা ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার পক্ষে সুপারিশ প্রস্তাব গ্রহণের কথা ছিল। আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।

কিন্তু ছাত্রদের বেশিরভাগই এই চুক্তি মেনে নিতে রাজি হননি। অধ্যাপক আবুল কাসেম ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখেও পড়েন। মহম্মদ তোয়াহা ‘চুক্তি এখনো চুড়ান্ত হয়নি’ বলে তাদের শান্ত করেন। তাদের দাবিতে পরদিন ১৬ মার্চ ধর্মঘট অব্যাহত থাকে এবং ১৭ মার্চ শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট চলে। তবে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্থগিত হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শান্তিচুক্তির প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন পূর্ব পাকিস্তান সফর। কারণ তার সফরকালে এমন একটি আন্দোলন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য অস্বস্তিকর ছিল। কিন্তু আরেকটি মত বলে থাকে, আন্দোলন বন্ধ করার জন্যই তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্রপ্রধানের ঢাকা সফরের ব্যবস্থা করা হয়।

১৫ মার্চের শান্তিচুক্তিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। আন্দোলনের মূল নায়কদের সম্পর্কে বশীর আল হেলাল বলেন, ‘মার্চের এই আন্দোলনে ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রনেতারাই বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তবে সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শামসুল আলম ছাড়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নেতৃস্থানীয় আর কোনো ছাত্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না।’ অন্যদিকে বদরুদ্দীন উমরের মতে, ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ এবং সাধারণ ছাত্রসমাজই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এইচএসএম/এজেড/ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪)