খুলনা ব্যুরো : সিন্ডিকেটের কারণে খুলনার টেন্ডারবাজি নিয়ে পত্রপত্রিকায় ইদানীং কোন সংবাদ প্রচারিত হয় না। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি ও বিরোধী দল সমর্থিত সাংবাদিকরা তো আছেই, এমনকি কট্টর সরকারবিরোধী সাংবাদিকরাও টেন্ডার সিন্ডিকেট নেতাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছেন।

এরকম টেন্ডার সিন্ডিকেটের অর্থের ভাগ পাওয়া সাংবাদিকের নামের তালিকা গোয়েন্দাদের হাতেও পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। নতুন সরকার আসার পর এই সিন্ডিকেট আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ২৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামছুজ্জামান মিয়া স্বপন বহুল প্রচারিত এক জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিককে মোবাইল ফোনে বলেন, ৩ লাখ টাকার তেল সরবরাহ কাজে টেন্ডারবাজি হয়েছে বলে বড় বড় সংবাদ করলেন, কিন্তু গত ৩ মাসে ৬০ কোটি টাকার ঠিকাদারী কাজ সিন্ডিকেট ভাগাভাগি করে নিল তখন কেউ লিখল না। তারা সাংবাদিকদের টেন্ডার সিন্ডিকেটের ভাগের টাকা দেয়, তাই লেখেন না? আর আমরা বৈধভাবে টেন্ডারে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের ভাগের টাকা দিই না তাই নিউজ হলো? ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, সত্য কথা লেখেন, যারা টেন্ডারবাজি করছে তাদের কথা লেখেন। দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। আর মিথ্যা লিখে সত্য ধামাচাপা দিয়েন না।

একটানা কথাগুলো বলে যান আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর। সাংবাদিক কোন উত্তর দিল না। মৃদুস্বরে জানান, আপনার প্রতিবাদ থাকলে দিয়ে যান, ছাপানোর ব্যবস্থা করা হবে।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান এমপি দলীয় হাইকমান্ডের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, টেন্ডার সিন্ডিকেট যেভাবে দলের মধ্যে টাকা বিলি বন্টন করছে, তাতে নেতাকর্মীদের চেইন অব কমান্ড থাকছে না। তাতে দল চালাতে আগামীতে বেগ পেতে হবে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কেন যে সাংবাদিকরা লেখে না? সাংবাদিকরা যদি ম্যানেজ হয়ে যায় তাহলে দেশ চলবে কিভাবে?

আওয়ামী লীগের এই নেতা ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাই মহানগর কমিটি সাধারণ সম্পাদক আমি, বদনাম আমার। অথচ টেন্ডার ভাগাভাগির আমি কিছুই জানি না।

মহানগর বিএনপির সভাপতি ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু সরকারি দলের টেন্ডারবাজির কথা প্রকাশ্যে বললেও সাংবাদিকদের নীরবতা নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজী নন। তিনি বলেন, বোঝেন তো, রাজনীতি করি।

মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা জানান, নির্বাচিত জননেতা, সরকারি দলের নেতা-পাতি নেতা সকলেই টেন্ডার সিন্ডিকেটের অর্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিগত জোট সরকার আমলে টেন্ডার সিন্ডিকেট না হলেও ফলাওভাবে নিউজ হতো। কিন্তু মহাজোট সরকার আর এই জগাখিচুড়ি সরকারের আমলে গত ২ মাসে ৬০ কোটি টাকার ঠিকাদারী কাজের সিন্ডিকেট হলেও কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। এখন সাংবাদিকরাও সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে টেন্ডার সিন্ডিকেটের মহাজোট হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক প্রকৌশলী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, গত মহাজোট সরকার আমলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবর রহমানের ছেলে ঠিকাদারী করতেন। তিনি প্রায় ১৮ কোটি টাকার কাজ সমঝোতা করে নিয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবর রহমান এই টেন্ডারের শিডিউল ক্রয়কারী ঠিকাদারদের কাছে মোবাইল করে বলেন, এই কাজটা তার ছেলে নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতির এমন ফোন পাওয়ার ফলে যা হবার তাই হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। তবে তার কোন প্রতিবাদ কেউ করেনি। বরং টেন্ডার সিন্ডিকেট সদস্যরা এই নিউজের কাটিং উচ্চ মহলে পাঠিয়ে তাদের কমিশন ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। সাংবাদিকরা ম্যানেজ হয়ে থাকায় কিছু দিন আগে নিম্ন দরে টেন্ডার দাখিল হবার পরও পরে সেই টেন্ডার ম্যানেজ করে আবার ঊর্ধ্বদর করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে অনেক ঠিকাদারকে কাজ না করা হলেও তার বিল ঠিকাদারকে পরিশোধ করার ঘটনা তদন্তে ধরা পড়েছে।

সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, টেন্ডার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সাংবাদিকরা জড়িত হয়ে পড়ায় খুলনায় ‘মহাজোট সাংবাদিক টেন্ডার সিন্ডিকেট’ করা হয়েছে। এই মহাজোট টেন্ডার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জাতীয় পত্রিকার প্রায় সকল স্থানীয় প্রতিনিধি, রয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মুখপত্র খ্যাত, ইসলামী আন্দোলনের ২টি মুখপত্রের প্রতিনিধিরাও।

গত সপ্তাহে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ৩ কোটি টাকার কাজের পর সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট কোটা হারে অর্থ দেওয়া হয়। এই সময় স্থানীয় সাংবাদিক প্রতিনিধিরা সাংবাদিক টেন্ডার সিন্ডিকেটের প্রধানের কাছে অভিযোগ করেন এবং সাংবাদিক নেতা হিসাবে স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকার প্রতিনিধির জন্য ‘ভাগা’ (অর্থ) দাবি করেন।

এই সূত্রে জানা গেছে, টেন্ডার সিন্ডিকেট সাংবাদিকদের এ, বি ও সি- তিনটি ক্যাটাগরি করে অর্থ ভাগাভাগি করেন। এতে ‘এ’ ক্যাটারগরির সাংবাদিকরা টেন্ডার প্রতি ৫ হাজার, ‘বি’ ক্যাটাগরি ৩ হাজার আর ‘সি’ ১ হাজার থেকে ৫ শত টাকা করে দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে বিরোধী দলের সমর্থক এক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই সময় লিখলে কিছু হয় না, তাই যা দেয় তাই নিয়ে চুপ থাকতে হয়। আর বড় বড় পত্রিকার সব সাংবাদিকই যখন ম্যানেজ তখন ২/৩ জন বিরোধী থেকে কি হবে? বরং জীবন বাচাঁতে তারা টাকা নিচ্ছেন, টাকা না নিলে তারা মনে করবে এরা মনে হয় টেন্ডার সিন্ডিকেটবিরোধী।

দৌলতপুর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের টেন্ডারের লটারি অনুষ্ঠিত হয় অফিসের পরিবর্তে একটি বাণিজ্যক কার্যালয়ে। এই এলাকায় বসবাসরত আঞ্চলিক এক সাংবাদিক নেতা নিজে কয়েকটি ঠিকাদারী কাজ নিয়ে পরে বিক্রি করে নানাভাবে আলোচিত হয়েছেন। দৌলতপুর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিন্ডিকেটের ভাগের এক কোটি টাকা সাবেক এক নেতার কাছে রয়েছে। যে টাকা দিয়ে তিনি মেয়ের জামাইয়ের নামে উত্তরায় প্লট নিয়ে বাড়ি তৈরি করছেন। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাংবাদিকদের কাছে টেন্ডার সিন্ডিকেট সম্পর্কে বলেন, ‘টেন্ডার সিন্ডিকেট বুঝি না, তবে তার দপ্তরে যেভাবে সমঝোতা করে টেন্ডারের কাজ ভাগ বটোয়ারা হচ্ছে তাতে সবাই লাভবান হচ্ছে। তাদের অফিসের কাজেও কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।’

সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পূর্ত বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার টেন্ডার সিন্ডিকেটের একজন সভাপতি রয়েছেন যিনি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই নেতা ১/১১ সরকার আমলে অবৈধ অস্ত্র ও চরমপন্থিদের সাথে সখ্যতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। টেন্ডার সিন্ডিকেটের সভাপতি হওয়ার পর মোটরসাইকেলের বদলে ৩ মাস পর পর গাড়ির মডেল বদলকারীদের তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। বর্তমানে তার পরিবারের সদস্যরা তিনটি দামী গাড়ির মালিক।

গত মহাজোট সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান খান খুলনা সফরকালে গণপূর্ত ভবনে এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার বাইরে যেখানেই যাই সেখানেই আগে শুনতে হয় টেন্ডারবাজির অভিয়োগ। কিন্তু খুলনা সফরকালে এই প্রথম কোন ঠিকাদার, প্রকৌশলী বা অন্য কেউ তার কাছে টেন্ডারবাজি কোন অভিযোগ করেনি।’

এ সময় সেখান্ উপস্থিত সাংবাদিকরাও নীরব ভূমিকা পালন করেন।

(দ্য রিপোর্ট/এটি/জেএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৪)