সাঙ্গাকারাময় দিনেও স্বস্তিতে বাংলাদেশ
আরিফ সোহেল, স্পোর্টস এডিটর, চট্টগ্রাম থেকে : সাঙ্গাকারার ট্রিপলে চড়ে সাগরিকার সাগরপাড়ে শ্রীলঙ্কা ৫৮৭ রানের পাহাড়ে। মাঠে নেই নিয়মিত অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। রানের চাপের সঙ্গে দল সামলানোর চাপও চট্টগ্রামের ছেলে তামিমের কাঁধে। সেই চাপ সইতে পারলেন না তিনি। হয়েছেন ব্যর্থ। তবে শুরুর ধাক্কা ইমরুল ও শামসুর সামলে ওঠে নির্বিঘ্নে দিন শেষ করেছেন। দিন শেষে এক উইকেট হারিয়ে দলীয় স্কোর ৮৬। ইনিংস ব্যবধানে হার এড়াতে এখনও প্রয়োজন ৩০২ রান। তারপরও স্বস্তিতে বাংলাদেশ। মজুত ৯ ব্যাটসম্যান; তাতেই!
১৬০ রানে অপরাজিত থেকে চট্টগ্রাম টেস্ট শুরু করা সাঙ্গাকারা বুধবার শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট ৩১৯ রানে। যদিও দ্বিতীয় দিনের ১৮তম ওভারে বাংলাদেশকে প্রথম সাফল্য এনে দিয়েছেন অকেশনাল নাসির হোসেন। এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে সাজঘরে ফিরিয়েছেন ৩৫ রান করা ভিথানাগেকে। আবার রেকর্ড গড়া সাঙ্গাকারাকে আউট করে শ্রীলঙ্কায় শেষ পেরেকও ঠুকেছেন নাসিরই।
সাঙ্গাকারা নিজের ট্রিপলের জন্য সবার আগে ধন্যবাদ দিতে পারেন অজান্তা মেন্ডিসকে। কারণ তার সঙ্গে অষ্টম উইকেটে ১০০ রানের জুটি গড়েছেন ওই ক্যারম বোলার। সাকিবের শিকারে পরিণত হওয়ার আগে মেন্ডিস করেছেন ৪৭ রান।
সাঙ্গাকারা সাগরিকায় ছক্কা মেরেই পূর্ণ করেছেন হাফ সেঞ্চুরি। পরের সবগুলো ১০০, ১৫০, ২০০, ২৫০ মাইলফলকের সঙ্গে যুক্ত বাউন্ডারি। তবে ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল ছুঁয়েছেন সাকিবকে ছক্কা মেরে। এর আগে শ্রীলঙ্কার হয়ে আরও ২ জন ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন; এদের একজন মাহেলা জয়াবর্ধনে, অন্যজন সনাথ জয়সুরিয়া। ৩০০-এর পাশাপাশি দারুণ ব্যাটিংয়ে অনন্য এক মাইলফলকও ছুঁয়েছেন সাঙ্গাকারা। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন টেস্ট ক্রিকেটের ১১ হাজার রানের এলিট ক্লাবে। তার আগে শ্রীলঙ্কার হয়ে ১১ হাজার রান করেছেন তারই সতীর্থ মাহেলা জয়াবর্ধনে। বুধবার সাঙ্গাকারা ছাড়িয়ে গেছেন ব্রায়ান লারা, শচিন টেন্ডুলকারকে। সবচেয়ে কম ২০৮টি ইনিংস খেলে তিনি স্পর্শ করেছেন ১১ হাজার রানের মাইলফলক। এর আগে লারা এখানে পৌঁছেছিলেন ২১৩ ইনিংস খেলে। বাংলাদেশের পক্ষে একাই ৫ উইকেট নিয়েছেন সাকিব আল হাসান। তার পেছনে রয়েছেন নাসির; নিয়েছেন ২ উইকেট। এ ছাড়া আল-আমিন, সোহাগ ও রিয়াদ প্রত্যেকে একটি করে উইকেট নিয়েছেন। হিসেবটা এমন; সাঙ্গাকারার ৩১৯ রান ছাড়া সবাই মিলে করেছেন ২৬৪ রান। সেখানেই শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস ৫৮৭ রান। অবশ্য শ্রীলঙ্কার রানের সঙ্গে ৫ রান পেনাল্টি হিসেবেও যোগ হয়েছে। তামিমের ছুঁড়ে দেয়া বলটি কিপারের পাশে হেলমেটে আঘাত করায় দন্ডি দিতে হয়েছে-এ যেন মরার ওপর খড়ার ঘা’র মতো।
চাপ নিয়ে ব্যাটিংয়ে দারুণ ছন্দময় রয়েছেন ইমরুল ও শামসুর। ৪৫ রানে অপরাজিত রয়েছেন শামসুর। আর ৩৬ রানে বৃহস্পতিবার নামছেন ইমরুল। তবে এক পর্যায়ে ললিপপ ক্যাচ তুলে দিয়ে বেজায় বিরক্তি প্রকাশ করে ড্রেসিংরুমের দিকেই চোখ রাখছিলেন ইমরুল। মেন্ডিসে প্রলুব্ধ হয়ে বাউন্ডারি নিশানা করে ব্যাট চালিয়েছেন। ভাগ্যদেবতা প্রসূন্ন বলেই ৩২ রানে জীবন পেয়েছেন তিনি। মিডঅফে বেশ ক্ষাণিকটা দৌড়ে গিয়ে; সময় পেয়েও সেই ক্যাচ তালুবন্দি করতে পারেননি নুয়ান প্রদীপ। দলের রান তখন ৭৭। আরেকটি জীবন পেয়েছেন শামসুর রহমানও। পেরেরাকে ব্র্যাশ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। আলতোভাবে হাতে লেগেছিল বলটি। কিন্তু কিপার দিনেশ চান্দিমাল তা ঝাঁপিয়েও কব্জা করতে পারেননি।
তামিম ইকবালের ধুন্ধুমার ব্যাটিং উচ্চাভিলাসে হকচকিয়ে গেছে চট্টগ্রামের ক্রিকেটভক্তরা। যেখানে তার কাছে প্রত্যাশা ছিল আকাশমুখী। স্বপ্ন-সাধনা ও সংগ্রামে ‘অধিনায়ক’ তামিম ইকবালের আর্বিভাব-ক্ষণ গণনার কথা; সেখানে তামিম ঢাকা টেস্টের মতো দলকে বিপদে রেখেই আউট হয়েছেন। পরবর্তী অধিনায়ক হওয়ার জায়গাও ফেলেছেন প্রশ্নের মুখে। অথচ সাঙ্গাকারা বড় ইনিংস খেলার বাতাবরণ তৈরি করেছেন সাগরিকায়; খেলেছেনও। তার ব্যাটিং আলোতে ক্রিকেটের রূপ-রস-মাধুর্য-রোমাঞ্চ সবটাই হাজির; সেখানে তামিমের ওমন আউটের মানে খুঁজতে হয়েছে বঙ্গোপসাগরে নুড়ি খোঁজার মতো। তামিমে আশা জাগানিয়া ব্যাটিংয়ে সম্মোহিত হতে যারা এসেছিলেন; তাদের নির্মম অনুশোচনায় পুড়তে হয়েছে। শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এসে ঘরের ছেলের বাজে ব্যাটিংয়ে টিপ্পনি কেটেছেন।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ নির্ভার ব্যাটিংয়ের দল নয়। এখানে একদিন ইমরুল-শামসুর তো আরেকদিন রিয়াদ-গাজীতে আলোর বাতিঘর জ্বালাতে পারে বাংলাদেশ। কারণ টেস্ট জেতার মতো গোলাবারুদ এখনও তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। সেখানে প্রতিজ্ঞা-দৃঢ়তা আর বোধ বিবেচনায় ব্যাটিং করে অনেক দূর যেতে হবে মুশফিক-সাকিবদের।
একজন নিবেদিত ব্যাটার সাঙ্গাকারা শুধু উপভোগ্য ব্যাটিংই জানেন না। জানেন কিভাবে আপন নিয়মে ব্যাটিং করা যায়। উইকেট ধরে খেলা যায়। দিনভর যখন সেই দৃশ্যের অবতারণা; তখন দুর্বোধ ব্যাটিং টেস্টে বড্ড বেমানান। তা ক্রিকেটভক্তদের হতচকিত করে; করে বিধ্বস্ত। কারণ আবেগ-উচ্ছ্বাসের কোনো জায়গা নেই টেস্টে। সুযোগ নেই বিনোদনের বাহারী গ্যালারি শোর। বরং বলে বলে চলে টানাপোড়েন; স্রেফ বুদ্ধি খাটিয়ে; দ্বিধাদ্বন্দ্ব সরিয়ে রানের পেছনে ছুটতে হয়। সুযোগ থাকে বিস্তৃততর আশা জাগানিয়া ব্যাটিংয়ে হৃদয়োচ্ছ্বাস প্রতিস্থাপনের। দলকে খাদ থেকে টেনে তোলার। টেস্টে সব সময় ক্রিকেটীয় সুধা-মাধুরী ব্যাটিং জেল্লা কখনও আশা করা যায় না। টেস্ট ক্রিকেট মানেই হিসেবী খেলার মহড়া; এখানে চলে ব্যাটিংয়ের যুগলবন্দির আত্মিক বন্ধন; থাকে ভালো বুঝা-পড়া গাণিতিক সমীকরণ। যেমনটা চট্টগ্রাম টেস্টে মাহেলা-সাঙ্গাকারার ব্যাটে প্রতিভাত হয়েছে। তাদের ব্যাটিং প্রতিভা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সারা সাগরিকায়।
ঢাকা টেস্ট সাড়ে ৩ দিনে হেরে যাওয়ার পর প্রতিশোধের স্ফূলিঙ্গ যেখানে পরিস্ফুট হওয়ার কথা; তা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। সাগরিকায় এখনও সম্ভাবনায় আলোকরশ্মি জ্বলজ্বল করছে। তামিম বাজে আউটের পরও ইমরুল-শামসুর ব্যাটে জেগে ওঠেছে নতুনের জয়গান। তাই সাঙ্গাকারাময় দ্বিতীয় দিন এখন বাংলাদেশহীন নয়।
সাগরিকায় পয়মন্তর মাঠে যারা নিজের টাকা খরচা করে ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করতে এসেছেন; জয় হোক সেই ক্রিকেটভক্তদের। উজ্জ্বল দিনের আহ্বান ডাকে স্বপ্নরঙিন হয়ে ওঠুক বাড়তে সেই প্রত্যাশাও। সে প্রত্যাশার ক্ষাণিকটা দেখা গেছে দ্বিতীয় দিন। পরের দিনের অপেক্ষায় তেমনই ভরে উঠেতে পারে গ্যালারি। কিন্তু পারবেন তো ক্রিকেটাররা। বুধবার মিডিয়া প্রতিনিধিদের সেই স্বপ্নময় কথাই জানিয়েছেন নাসির হোসেন। বলেছেন, ‘আমরাও চেষ্টা করব উইকেট আগলে রেখে ব্যাটিং করার; টিকে থাকার।’
সাগরিকায় এখনও ইনিংস ব্যবধান এড়াতেই প্রয়োজন পাক্কা ২০২ রান, সেখানে অবশ্যই ব্যাটিং স্টাইলে যৎকিঞ্চিৎ পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন অনিবার্য। প্রলম্বিত করতে হবে উইকেটে টিকে থাকায় সময়। হারের বন্দীশালার দুর্বিপাক থেকে ড্র’র দিকে নিতে হলে প্রয়োজন লম্বা ব্যাটিং পান্ডুলিপির উপস্থাপনা; ব্যতিক্রমী ব্যাটিং মহড়া। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সর্বগ্রাসী ব্যাটিং ক্ষুধা অবনমনের পাশাপাশি মারকুটে স্বভাবকে বির্সজন দিতে হবে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
শ্রীলঙ্কা : প্রথম ইনিংস ৫৮৭/১০, ১৫৬.৪ ওভার ( সাঙ্গাকারা ৩১৯, মাহেলা ৭২, অজান্তা মেন্ডিস ৪৭, ভিথানাগে ৩৫ ; সাকিব ৫/১৪৮, নাসির ২/১৬)।
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস ৮৬/১, ২৫ ওভার (শামসুর ৪৫*, ইমরুল ৩৬*, তামিম ০)।
দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে
(দ্য রিপোর্ট/এএস/সিজি/এএল/ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪)