দ্য ‍রিপোর্ট ডেস্ক : ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। তিনি মোট তিনটি সভায় বক্তৃতা দেন। সে সব সভায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের মতটিই পুনর্ব্যক্ত করেন। বক্তৃতায় তিনি পূর্ববঙ্গের ভাষার দাবিকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তিনি বক্তৃতা দেন- ঢাকার রেসকোর্স ময়দান, কার্জন হল ও পাকিস্তান বেতারে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তার বক্তব্য ছিল এমন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কমিউনিস্ট ও বিদেশি চরদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। রাষ্ট্রবিরোধীদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

জিন্নাহর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ঢাকার ছাত্রসমাজ কখনো সরবে কখনো নিরবে প্রতিবাদ জানায়। রেসকোর্সের জনসভা সম্পর্কে সাঈদ হায়দার বলেন, প্রতিবাদ উচ্চারণের বদলে ছাত্রসমাজের একাংশ সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে সাজানো তোরণে কিছু ভাংচুরও করে। অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া লিখেন, জিন্নাহ সাহেবের ভাষাবিষয়ক বক্তব্যের পর তাদের কিছু কর্মী ও ছাত্র নো নো বলে চিৎকার করে উঠে এবং সভায় হইচই শুরু হয়ে যায়। ওই জনসভায় উপস্থিত কমিউনিস্ট কর্মী সরদার ফজলুল করিম লিখেন, জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার দিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম… জিন্নাহ সাহেব উর্দুতে ভাষণ দেন। বক্তৃতা করতে করতে এক জায়গায় তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কমিউনিস্ট আছে, তোমাদের মধ্যে গুপ্তচর আছে, তোমাদের তারা বিভ্রান্ত করছে। আমি বলছি ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তাতে উর্দু, কেবল উর্দু্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। জিন্নাহ সাহেবের ভাষণ শোনার পর ছাত্ররা এতই মর্মাহত হয়েছিল যে, হলে ফেরার পথে (সংবর্ধনার জন্য তৈরি) তোরণ তারা ভেঙ্গে ফেলে। অনেকে বলেছেন, জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্সে ভাষণদানকালে ভাষার প্রশ্নে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তার প্রতিবাদ সেখানেই হয়েছিল। কিন্তু এ কথা ঠিক না। আমি একজন সচেতন কর্মী হিসাবেই সেখানে গিয়েছিলাম… সেখানে কোনো বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ আমি লক্ষ করিনি।

২৪ মার্চ জিন্নাহ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দেন। সেখানে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে কথা বললে ছাত্রদের একাংশ নো নো বলে উঠে। কার্জন হলে উপস্থিত সরদার ফজলুল করিমও একই কথা বলেছেন। সেখানে স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানের স্থপতি হিসেবে জিন্নাহ নতুন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু তারপরও বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি বা বুঝেও ক্ষমতার ভাষায় ব্যবহার করেছেন।

জিন্নাহর বক্তৃতা নিয়ে ঢাকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। ব্যতিক্রম ছিলেন শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি জিন্নাহ সাহেবের অগণতান্ত্রিক ও বাংলাবিরোধী বক্তৃব্যের প্রতিবাদে ২৩ মার্চ এক বিবৃতি দেন। ‘হক ছাহেবের হুঙ্কার/কায়েদে আজমের প্রতি জঘন্য আচরণ’ এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ এই বিবৃতিটি ছাপে।

২৪ মার্চ সন্ধ্যায় জিন্নাহর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাত করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাশেম, মহম্মদ তোয়াহা, শামসুল হক ও অলি আহাদ প্রমুখ। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জিন্নাহ তার অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি। সর্বশেষ বেতার বক্তৃতায়ও একই কথা বলেন।

মূলত জিন্নাহর বক্তব্যের মাধ্যমেই পাকিস্তানী শাসকদের মনোভাবের চরম দিকটি উম্মোচিত হয়। স্পষ্ট হয়ে যায় রাষ্ট্রভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবি মুসলিম লীগ সরকার কোনোভাবেই মেনে নেবে না।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউিএস/এইচএসএম/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৪)