সাগরিকা কী আবারও ঢালি হাতে!
আরিফ সোহেল, স্পোর্টস এডিটর, চট্টগ্রাম থেকে : হার; না ড্র-এমন সুতোয় ঝুলছে বাংলাদেশ। অথচ সাগরিকায় সামগ্রিক অবয়ব-পরিবেশ সবটাই অনুকূলে বাংলাদেশের। উইকেট বুঝেছে ব্যাটসম্যানদের ভাষা। ওই ভাষা পড়তে পড়তেই বাংলাদেশের ব্যাটাররা ভাষামাসে শ্রীলঙ্কাকে অনেকটা সময় ভাষাহীন করে রেখেছিল। রানের পিঠে রান তুলে; দারুণ জবাব দিয়ে ইমরুল-শামসুর-সাকিব-নাসিরারা জানিয়ে দিয়েছেন; রানের পর্বতে চড়েও চোখ প্রাদপ্রদীপের বাইরে রাখার উপায় নেই। বলা যায়, টেস্ট খেলার মেধা-মননের মশাল প্রজ্জ্বলন করে তারা এখনও আলোকিত করে রেখেছেন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। বাঁচিয়ে রেখেছেন সম্ভাবনা। তবে কী সাগরিকা আবারও ঢালি হাতে বাংলাদেশের অপেক্ষায়; এমন স্বপ্বও উঁকি দিচ্ছে।
এখন আর শ্রীলঙ্কার ৫৮৭ রানে ইনিংস হারিয়ে দেয়ার চোখরাঙানির ছিটেফোঁটা নেই। ইমরুল-শামসুরের জোড়াসেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের স্কোর এখন ৪০৯/৮। থাকছে শুধু শেষ সেশনে ৪ উইকেট খোয়ানোর কষ্টময় ইতিবৃত্তান্ত। যেখানে নাসির আউট না হয়েও হয়েছেন মনমতলবির আউট!
বলে নেই;- এই সাগরিকার উইকেট দ্বিতীয় দিনই স্নাত হয়েছে সাঙ্গাকারার ট্রিপল সেঞ্চুরিতে (৩১৯ ); বাকি ৯ জনের মোট রান ২৬৪। এক ট্রিপলেই সাঙ্গাকারা গড়েছেন বিশ্বময় অনেকগুলো রেকর্ড। ছাড়িয়েছেন শচিন-লারাকে।
রানের বড় চাপ সাগরিকায়! ৮৬/১-এই নিয়েই বৃহস্পতিবার শুরু বাংলাদেশের। আগের দিনের দারুণ ছন্দময় শামসুর (৪৫) এবং ইমরুল (৩৬) নতুন করে ইনিংস শুরু করেছেন। আর শেষ পর্যন্তও ছিলেন অবিচল; ছিলেন টেস্ট মেজাজে। এক কথায় তাদের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ও মান বাঁচানো জোড়া সেঞ্চুরি অবগাহণ করেছেন ভক্তরা। তাদের ব্যাটিংআলোতে ক্রিকেটের রূপ-রস-মাধুর্য-রোমাঞ্চ সবটাই হাজির হয়েছে সাগরিকায়। তাদের আশা জাগানিয়া ব্যাটিংয়ে সম্মোহিত হয়েছেন ক্রিকেটভক্তরা। কেটেছে ইনিংস হারের যাতনার শঙ্কাও।
স্কোর বোর্ডে ৪০৯/৫ হলে; ভালো হতো। এখন উইকেটের ঘরে ৮। ফলে মোটের ওপর ক্ষাণিকটা এগিয়ে শ্রীলঙ্কাই। বৃহস্পতিবার রানের চাপ প্রথম সেশনে একটুও সামনে এসে দাঁড়ায়নি। কারণ ২০১/১-এ থেকেই লাঞ্চ বিরতি গিয়েছে বাংলাদেশ।
দারুণ জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের ২ ব্যাটসম্যান শামসুর ও ইমরুল। দুজনেই করেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। এর মধ্যে ২০১১ সালের পর দলে জায়গা পাওয়া ইমরুল ২ বার জীবনের বিনিময়ে সেঞ্চুরি পেলেও চলতি সিরিজের টেস্ট ক্যাপ পড়া শামসুর রহমান খেলেছেন সলিড সেঞ্চুরি। ২৩২ রান এসেছে তাদের যৌথপ্রযোজনায়। তাদের বুঝা-পড়ায় বাংলাদেশকে নির্ভার মনে হয়েছে। এটা দ্বিতীয় উইকেটে তোলা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান। এর আগে ঢাকায় ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে তামিম-জুনায়েদ ২০০ রানের পার্টনার্শিপ গড়ে তালিকার শীর্ষে ছিলেন। আর যে কোনো উইকেটে ২৬৭ রানের সর্বোচ্চ রেকর্ডটি এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে। গেল ২০১৩ সালে ওই জুটিবদ্ধ রান করেছেন আশরাফুল-মুশফিক।
বৃহস্পতিবার; টেস্টের তৃতীয় দিন বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন ঢাকা টেস্টে ৩৩ ও ৯ রান করা শামসুর। তিনি ম্যাথুসকে কভার ড্রাইভে সীমানায় পাঠিয়ে সেঞ্চুরি স্পর্শ করেছেন। দীর্ঘ ২৪৩ মিনিট উইকেট ধরে রেখে ১৮১ বলে ক্যারিয়ারে অভিষেক সেঞ্চুরি করেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৬ রান যোগ করেই শামসুর ফিরে গেছেন মেন্ডিসের একটি নিচু হয়ে আসা বলে। তিনি ব্যাট চালাতে গিয়ে ফ্লাইট মিস করেছেন। ২৬২ মিনিট তিনি সংগ্রাম করেছেন ১৯১টি বল।
ইমরুল কায়েস ৯৫ রানে বড় বাঁচা বেঁচেছেন। মেন্ডিসকে স্টিয়ার করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন পয়েন্টে। তা সহজতর হওয়ার পরও হাতে রাখতে পারেননি ভিথানাগে। একই ওভারে ২ বল পরে আবারও বেঁচেছেন ইমরুল। এবার ত্রাতা বোলার নিজেই। এবার পয়েন্টে ক্যাচার ভিথানাগে; দারুণ লুফেও নিয়েছেন। কিন্তু আম্পায়ার জানিয়েছেন, ‘নো’। আবারও কপাল পুড়েছে মেন্ডিসের। এর আগের দিন ৩১ রানেও ক্যাচ ড্রপ হয়েছিল ইমরুলের। তবে ১৭তম ম্যাচে টেস্ট সেঞ্চুরির পথে ইমরুল লাকমালেকে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছেন। দীর্ঘ ২৫৪ মিনিট লেগেছে ওই আরোধ্য মাইলফলক স্পর্শ করতে। খেলেছেন ১৮৫ বল। আউট হওয়ার আগে ৩০৪ মিনিট উইকেটে থাকা ইমরুল ১১৫ রানের ইনিংস খেলেছেন। অবশ্য তার আউটের সঙ্গে সেই অভিন্ন শত্রু মেন্ডিসেরই নাম ছিল। ইমরুলও বোল্ড হয়েছেন শামসুরের মতো। তবে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়ে হুট করে পড়ে গেছেন ইমরুল। তাতে কিছুটা ব্যথাও পেয়েছেন কুচকিতে। তবে তার ব্যাটিং নিয়ে সেই অর্থে কোনো শঙ্কা নেই। এর আগে টেস্টে ইমরুলের সর্বোচ্চ রান ছিল ৭৫; লর্ডসে; করেছেন ২০১০ সালে।
সাকিব-মুশফিকের নতুন প্রেরণা যুক্ত হতে হতেও হয়নি। প্রায় সেটও হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ৩১৯ রানের মাথায় হুট করেই মুশফিক বোকা বনেছেন পেরেরায়। ক্যাচ দিয়েছেন শর্ট কাভারে সিলভার হাতে; ব্যক্তিগত ২০ রানে। এক ঘণ্টা ১১ মিনিট উইকেটে ছিলেন মুশফিক। তিনি ব্যাথানাশক ইনজেকশন নিয়েই মাঠে নেমেছেন। বৃহস্পতিবারও নিশ্চিত হওয়া যায়নি; কবে সুস্থ্য মুশফিককে পাওয়া যাবে। আঙুলে হালকা ব্যথা থাকায় এখনও শঙ্কামুক্ত হননি মুশফিক।
আরেকটি হাফসেঞ্চুরি পেয়েই মনে হয়েছে আনন্দে আটখানা হয়ে যাচ্ছিলেন সাকিব। নিউজিল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দেয়া অক্টোবরের ড্র টেস্টেও সাকিব রানের মধ্যে ছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ৫০*। আবারও সেই ৫০ রানেরই ধারাবাহিকতার প্রমাণ দিয়েছেন; এই যা। অথচ এমন পরিস্থিতিতে আরও দেবার কথা সাকিবের।
নাসির-মাহমুদউল্লাহ ৪৭ রানের জুটিবদ্ধ রান; ইনিংস ব্যবধানের হারকে ‘না’ করার উপলক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। ৩৮৭ রানেই ইনিংস ব্যবধানে হারের বিষয়টি উবে গেছে। দলীয় ৩৯৮; নাসিরের ৪২। তারা খেলছিলেনও দুর্দান্ত। কিন্তু ব্যাটে না লাগিয়েও নাসির শিকার হয়েছেন বাজে আম্পায়ারিংয়ের। মেন্ডিসের বলটি নাসিরের ব্যাট-হাত-গ্লভসে না লাগলেও, দিনেশ চান্দিমালের আবেদনে অনাহুতভাবে সাড়া দিয়েছেন আম্পয়ার। ওই আউটেই পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। ওই আউটে কতটা ক্ষুব্ধ তা বুঝা গেছে ম্যাচোত্তর সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে সেঞ্চুরিয়ান শামসুর রহমান বলেছেন, ‘ওটা আউট ছিল না। ওই আউটের কারণেই আমরা বেশ পিছিয়ে পড়েছি।’
নাসির ফিরে যাওয়ায় সব আলো শেষ হয়ে যায়নি বাংলাদেশের। এখনও সেখানে বাতিঘর হয়ে প্রজ্জ্বলন শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন স্পিনিং কোটায় চট্টগ্রাম টেস্টে জায়গা পাওয়া মাহমুদউল্লাহ। ব্যাট করছেন; রয়েছেন অপরাজিত। শুক্রবার ৩০ রানে নামা এই অলরাউন্ডার মাহমুদউল্লাহকে সঙ্গ দেবেন ঢাকা টেস্টের ‘বিনোদন-ব্যাটার’ আল-আমিন (৩*)। শেষ ব্যাটসম্যান আব্দুর রাজ্জাক রাজকে পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় দিন তিনিও ইনজুরিতে পড়েছিলেন। শঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল তাকে ঘিরেও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই মাঠে সেঞ্চুরি করা মমিনুল (১৮১) সুইপ করেছেন অনেকটা বোকার মতো। ওই ম্যাচের সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিক রেকর্ড করা সোহাগ গাজীও ব্যর্থ হয়েছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দুজনই পড়েছেন এলবিডব্লুর ফাঁদে। শ্রীলঙ্কার হয়ে গতকাল ৪টি উইকেট তুলে নিয়েছেন মেন্ডিস। সঙ্গে পেরেরার ৩। দুজনই স্পিনার।
এখনও বাকি ৬ সেশন। ওভার কমবেশি ১৮০। শুক্রবার কমপক্ষে ১টি সেশন খেলার সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। সঙ্গে আরও কিছু রান; ৫০ থেকে ১০০। ব্যাট হাতে ওই রান করার সুযোগ এখনও যে রয়েছে তা কিন্তু বৃহস্পতিবার ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে বলে গেছেন অজান্তা মেন্ডিস। বলেছেন, ‘উইকেট শতভাগ ব্যাটিংবান্ধব।’ তার মানে টিকে থাকলেই রান; এটা বুঝানো চেষ্টা করেছেন মেন্ডিস।
বাংলাদেশ এখনও ১৭৮ রানে পিছিয়ে। শামসুর-ইমরুলের জোড়া সেঞ্চুরি মনে করিয়ে দিচ্ছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অক্টোবরে খেলা টেস্ট ম্যাচের কথাও। সেই ম্যাচে মমিনুল ও সোহাগ গাজী সেঞ্চুরি করেছিলেন। ফলোঅন হতে পারে এমন টেস্ট; হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে সাকিবের ৫ উইকেট তুলে নেয়ার ঘটনা অষ্টম। এর মধ্যে সাকিব নিজেই নিয়েছেন ৬ বার। সাগরিকায় চলমান টেস্টসহ বাংলাদেশ মোট ১১টি ইনিংসে ৪০০ প্লাস রান তুলেছে। এর মধ্যে দেশের মাটিতে ৮টি; আর বিদেশে ৩টি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
শ্রীলঙ্কা : প্রথম ইনিংস ৫৮৭/১০, ১৫৬.৪ ওভার ( সাঙ্গাকারা ৩১৯, মাহেলা ৭২, অজান্তা মেন্ডিস ৪৭, ভিথানাগে ৩৫ ; সাকিব ৫/১৪৮, নাসির ২/১৬)।
বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস ৪০৯/৮, ১১৫ ওভার (শামসুর ১০৬, ইমরুল ১১৫, সাকিব ৫০, নাসির ৪২, মাহমুদউল্লাহ ৩০*;মেন্ডিস ৪/৮৪, পেরেরা ৩/১১৯)।
(দ্য রিপোর্ট/এএস/ওআইসি/এএল/ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৪)