সংলাপের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা আওয়ামী লীগের কাছে সংলাপের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বিএনপি বিহীন দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে নির্বাচন পরবর্তী যে সম্ভাব্য কৌশল আওয়ামী লীগের ছিল সেই জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে দলটি।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দলটির শীর্ষ পর্যায়েও দশম সংসদ নির্বাচনের পর সংলাপের মাধ্যমে একাদশ নির্বাচন আয়োজনের ভাবনা ছিল। নাম প্রকাশ না করে দলটির দায়িত্বশীল এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, গত নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এটা (দশম সংসদ) ৬ মাসের নির্বাচন। অপেক্ষা করেন। পরের নির্বাচনে মূল্যায়ন করা হবে।
কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই সরকার নিজেকে শক্তিশালী ভাবছে। বিশেষ করে নির্বাচনের পরে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা এবং দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় সরকারের জন্য ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
দেশি-বিদেশি সমালোচনার মধ্যেই দায়িত্ব নিয়েছিল বর্তমান সরকার। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের তকমা মাথায় নিয়ে কাজ শুরু করেছে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদ। রাজনীতি সচেতনদের মধ্যে ধারণা ছিল, নির্বাচন শেষ হলে পরবর্তীতে ’৯৬ সালের মতো নতুন নির্বাচনের দিকে এগুবে দেশ। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই শক্তিশালী হচ্ছে সরকার। আসছে নানান দেশের অভিনন্দন বার্তা। স্বাভাবিকভাবে চলছে দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বার বার সংলাপের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা কৌশলে সংলাপের দুয়ার খোলা আছে বললেও পুরনো শর্তে নতুন চাল দিচ্ছেন। একদিকে তারা বলছেন, যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে তাই পরবর্তী নির্বাচনও সংবিধান অনুযায়ী হবে (পাচঁ বছর পর)। অন্যদিকে বিএনপির সংলাপ চাওয়াকে নাকচ না করে বলছেন, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ, সহিংসতা বন্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে সমর্থন দিলে সাবেক এই প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের।
৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দশম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয়বার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘অনির্দিষ্টকাল ধরে শুধু সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানিয়েই যাব, এমন ভাবারও কোনো কারণ নেই। রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান আছে, তা থেকে বুঝি যে, আজকের সভ্য পৃথিবীতে দু-একটি সার্টিফিকেট জোগাড় করে এই অন্যায় ও অবৈধ শাসনকে প্রলম্বিত করা সম্ভব নয়।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যের বিপরীতে ৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘বিএনপিকে দল গোছানোর জন্য পাঁচ বছর সময় দেওয়া হলো। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে হবে। শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এ পর্যন্ত তৃতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। প্রথমদিকে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তৃণমূল রাজনীতির পরিস্থিতি অঘোষিতভাবে উপজেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে বাধ্য করেছে দলটিকে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে বিএনপি স্বীকার করতে না চাইলেও উপজেলায় দলটির ‘কৌশলী’ অংশগ্রহণ প্রকারান্তরে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে স্বীকার করে নেওয়ারই শামিল কিনা? জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় বিষয়। এখানে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ করার কোনো দলেরই সুযোগ নেই।’
কিন্তু এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আপনারা অবৈধ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলছেন। তাদের অধীনেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কোনো অবস্থানও তো নিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বিষয়ে আমাদের অবস্থান জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কোনো অবস্থানের কথা বলিনি।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের দৃষ্টি এখন উপজেলায়। জানা গেছে, সরকার চায় ছয় দফায় উপজেলা নির্বাচন শেষ হোক। ইতোমধ্যে তিন দফার ঘোষণা হয়েছে। তাতে দীর্ঘদিন কেন্দ্র থেকে মাঠের রাজনীতিতে মানুষের দৃষ্টি ধরে রাখা যাবে। সরকারের প্রত্যাশা, তাতে স্বাভাবিক থাকবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একজন নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকার তো দাপটের সঙ্গেই চলছে। নতুন নির্বাচন সংলাপের কি দরকার? উপজেলা নির্বাচনের পরে ২১ আগস্টের বিচার প্রক্রিয়া ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে মানুষের দৃষ্টি বর্তমান সরকারের জন্য ইতিবাচক মনোভাবই বয়ে আনবে। ফলে ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠা এই সরকারের পূর্ণ মেয়াদে থাকা কোনো সমস্যা হবে না। একই সঙ্গে বর্তমান সরকার গঠন হওয়ার পর বিগত সরকারের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সরকারের কয়েকজন এমপির সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শেখ হাসিনার টানা দ্বিতীয়যাত্রাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।’
তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিহীন দশম সংসদ নির্বাচনের ‘বৈধতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ছাড়া প্রায় সবাই। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দশম সংসদ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন হয়নি।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদ সরকারের সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এমন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি যা নতুন আলোচনা বা সংলাপের ক্ষেত্র তৈরিতে সরকারকে বাধ্য করে।
তবে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দল ও সরকারের সর্তক দৃষ্টি আছে। তাদের মধ্যেও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন নিয়ে উপলব্ধি আছে। কিন্তু বর্তমান সরকার গঠন হওয়ার পর বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা ও ‘পোষমানা’ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সরকার নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা।
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি দ্য রিপোর্টকে বলেন, এই বিষয়ে আমাদের সিনিয়র নেতারা প্রতিদিনই তাদের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। এই মুহূর্তে নতুন কিছু বলার নেই।
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এইচএসএম/এএল/ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৪)