জামায়াতের বিরুদ্ধে মার্চে তদন্ত, এপ্রিলে মামলা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ অভিযোগের তদন্তকাজ এ বছরের মার্চ মাসে শেষ হচ্ছে। আর আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে এপ্রিলে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার একাধিক সূত্র দ্য রিপোর্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এ তদন্তের মাধ্যমে প্রথম সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তদন্ত করে বিচার শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে চার ধরনের অপরাধের ওপর ভিত্তি করে তদন্তকাজ শুরু করে। আর চূড়ান্ত তদন্তের কাজ আগামী মার্চ মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। তদন্ত শেষ করে সংগঠনটির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্নিবেশিত করে তা চিফ প্রসিকিউটরের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর প্রসিকিউশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবে। আদালত যদি অভিযোগ গ্রহণ ও গঠন করে, তাহলেই জামায়াতের বিপক্ষে বিচার শুরু হবে।
বাংলা একাডেমি থেকে মুক্তিযুদ্ধসম্পর্কিত প্রদত্ত তথ্যাবলী, পত্রিকার কাটিংসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এ তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তদন্তের অগ্রগতি হয়েছে। তবে শেষ করতে আরও মাসদুয়েক লাগবে।’
ডকুমেন্ট হিসেবে অন্য মামলার তদন্ত করার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে যা যা পাওয়া গেছে, সেগুলোই মূলত তথ্য-উপাত্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
তদন্ত সংস্থার প্রধান আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার সময় জামায়াতের উদ্দেশ্য কী ছিল, বর্তমানে তাদের কার্যক্রম কী, তা তদন্তে উল্লেখ থাকবে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা- এই চার ধরনের অপরাধের উপর ভিত্তি করে মূলত তদন্তের কাজ করা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া বেশিরভাগ রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। এটি প্রমাণ করাই হবে আমাদের মূল কাজ।’
ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা সানাউল হক বলেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে কতটি অভিযোগ দাখিল করা হবে, সে ব্যাপারে তদন্ত শেষ করার পর প্রসিকিউশন টিমের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ছবি ডকুমেন্ট হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদনে থাকবে বলেও জানান তিনি।
জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত টিমের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন’- মূলত এ বিষয়টিকে প্রমাণের জন্যই তদন্ত করা হচ্ছে। এ জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আশা করছি, মার্চ মাসে আমরা তদন্ত রিপোর্ট প্র্রসিকিউশনের কাছে জমা দিতে পারব।’
ডকুমেন্ট হিসেবে কী কী রাখা হবে- জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনার বিভিন্ন দলিল, ওই সময়েদেশ-বিদেশে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা, দেশে ও দেশের বাইরের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত জামায়াতের কর্মকাণ্ডের বিবরণ, জামায়াত নেতাদের লিখিত বই এবং তাদের দেওয়া বক্তব্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এ সব থেকে প্রয়োজনীয় ‘ডকুমেন্ট’ তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদা) হায়দার আলী বলেন, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর অন্যান্য মামলার মতো করেই বিচার শুরু হবে।
একটি সংগঠন তো নিজে কিছু করতে পারে না, সুতরাং জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে আসামি করা হবে কাকে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতের সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দকে সংগঠনের পক্ষে জবাবদিহিতা করার জন্য আসামি করা হবে।
প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম বলেন, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদালতে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করা হবে।
ট্রাইব্যুানালের আরেক প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকিউটরের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর প্রসিকিউশন বিশ্লেষণ করে দেখবে সেখানে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের মতো কিছু আছে কি না। যদি থাকে তাহলে আমরা ট্রাইব্যুনালে তা দাখিল করব। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিলেই বিচার শুরু হবে।’
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের দেওয়া অধিকাংশ রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) বলে অভিহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির কোনো ব্যক্তিকে যেন রাষ্ট্রীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত করা না হয়, সে ব্যাপারেও পর্যবেক্ষণ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ আইনে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে বিচার করার বিধান ছিল না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে এ আইনটি সংশোধন করার সময়ও এমন কোনো বিধান রাখেনি। পরবর্তী সময়ে গণজাগরণ মঞ্চের চাপের মুখে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে আইনটি পুনরায় সংশোধন করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ও ব্যক্তির পাশাপাশি অপরাধী হিসেবে সংগঠনেরও বিচার করার বিধান সংযুক্ত করা হয়, যার ফলে জামায়াতের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে করা সম্ভব হচ্ছে।
(দ্য রিপোর্ট/এসএ/এইচএসএম/এজেড/আরকে/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৪)