কাঙ্ক্ষিত ফলাফল মিলছে না
চায়ের উৎপাদন হ্রাস, বেড়েছে আমদানি
ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে চায়ের উৎপাদন। পাশাপাশি চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর নানা জাতের চা আমদানি করতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক পর্যায়ে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে দেশের সবচেয়ে পুরনো এ শিল্প।
সরকারের ভুল নীতির কারণে চায়ের আমদানি বাড়ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশি চা সংসদ। চায়ের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ায় চায়ের আমদানি বেড়ে যাচ্ছে।
তাদের হিসাব অনুযায়ী, সম্পূরক শুল্ক হ্রাসের সুবিধা নিয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৩৫ লাখ কেজি চা আমদানি করা হয়েছে।
আগে চা আমদানির ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ ছিল। ওই সময় চায়ের আমদানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ কেজির নিচে। কিন্তু চায়ের ওপর থেকে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে দেওয়ায় চায়ের আমদানি বাড়তে থাকে।
অন্যদিকে বিরূপ আবহাওয়া এবং দেশের চা বাগানগুলোয় উন্নয়নমূলক কোনো কাজ না হওয়ায় ক্রমেই চা উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে যে হারে চা উৎপাদন হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে আট বছর পর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে আরও বেশি আমদানিনির্ভর হতে হবে।
১৮৪০ সালে প্রথম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। বিগত কয়েকটি সরকার চা শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে এ শিল্প।
বিশেষ করে চা শিল্পের বিকাশ ও রফতানির স্বার্থে কোনো আর্থিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেনি বিগত সরকারগুলো। তাই দিন দিন রফতানি হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন কমে গেছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে চা শিল্পের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চা বোর্ড। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান্ট ফর টি ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ ভিশন ২০২১।’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন ১০০ মিলিয়ন (১০ কোটি) কেজিতে উন্নীত হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯১৭ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বছরে চা উৎপাদন বাড়বে ৪০ মিলিয়ন (৪ কোটি) কেজি। আর এ থেকে বছরে রাজস্ব আয় হবে ৫০০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয় হবে দুই বছরের মধ্যে তা উঠে আসবে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প তিন দফায় বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় ৩৬৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় দফায় ৩৯৭ কোটি ২২ লাখ টাকা ও তৃতীয় দফায় ১৫৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-উন্নয়নমুখী চা বাগানগুলোর উন্নয়ন করা, রুগ্ন বাগানের যত্ন নিতে ঋণ সুবিধা প্রদান, ছোট বাগান সম্প্রসারণ, চা ফ্যাক্টরির উন্নয়ন, টি এস্টেটে গাছ লাগানো, চা ছাড়া বাগানের অন্য ফসলের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ, চা শিল্প কম্পিউটারাইজড, শ্রমিকদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ, পিডিইউ ও বিটিআরআই শক্তিশালী করা এবং শ্রমিক ওয়েল ফেয়ার ফান্ড গঠন করা। কিন্তু প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত হারে উৎপাদন বাড়ছে না।
চা সংসদ সূত্রে জানা গেছে, নর্থ বেঙ্গলের ৯টি চা বাগানসহ দেশে বর্তমানে ১৬৫টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪টি চা বাগান রুগ্ন। এসব বাগান থেকে বর্তমানে প্রায় ৬০ থেকে ৬৪ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়। দেশের চাহিদা মেটাতে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন কেজি চায়ের প্রয়োজন হয়। বাকি চা বিদেশে রফতানি করা হয়।
চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (বাণিজ্য) নবী হোসেন জানান, ‘২০০৫ সালে দেশে ৬০ দশমিক ১৪ মিলিয়ন কেজি চায়ের উৎপন্ন হয়। পরের বছরগুলোয় চায়ের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে দেশে চা উৎপাদন হয় ৫৩ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন কেজি, ২০০৭ সালে ৫৭ দশমিক ৯০ মিলিয়ন কেজি, ২০০৮ সালে ৫৭ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন কেজি, ২০০৯ সালে ৫৮ দশমিক ২৪ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১০ সালে ৬০ দশমিক ০৪ মিলিয়ন কেজি, ২০১১ সালে ৫৯ দশমিক ১৩ মিলিয়ন কেজি, ২০১২ সালে ৬২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে।’
চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের চা উৎপাদনে বিপর্যয়ের মূল কারণ নতুন প্ল্যান্টেশন না হওয়া। চা চাষের জন্য বরাদ্দ ভূমির প্রায় অর্ধেক এখনও অনাবাদী রয়েছে। অধিকাংশ চা বাগানেই চা গাছগুলো অনেক পুরনো ও বয়স্ক হয়ে গেছে। বয়স্ক গাছের ফলন ভালো হয় না। একটি চা গাছের বয়স ৪০ বছর পার হওয়ার পর তার উৎপাদন ক্ষমতা এক-চতুর্থাংশ এবং ৬০ বছর পার হলে ৭৫ শতাংশ হারিয়ে ফেলে। সাধারণত ৬০ বছরের অধিক বয়সী চা গাছ বাগান থেকে উঠিয়ে নতুন গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। অথচ দেশের চা বাগানগুলোয় এখনও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চা গাছই ৬০ বছরের বেশি বয়সী। এ নিয়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও তা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তারা চা শিল্প উন্নয়নে ৬০০ মিলিয়ন টাকার আর্থিক সহায়তা, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ১২০ কোটি, চা উৎপাদনে ঋণের সুদের হার কমানো, বাগানগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন চা সংসদের নেতারা।
চা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার কৃষিখাতে ঋণ দিতে পারলে চা শিল্পখাতে ঋণ দিতে সমস্যা কোথায়? এর আগে চা শিল্পে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা ব্যাংকের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের দেওয়া হয়েছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে চা বোর্ডের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। চা বোর্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণ সুবিধা প্রদান করলে চা শিল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। গৃহীত প্রকল্পের আওতায় স্মল হোল্ডিং টি চাষের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। বর্তমানে ২৯৬টি স্মল হোল্ডিং টি বাগান রয়েছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে পাঁচ হাজারে উন্নীত করা হবে। এতে সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে নতুনভাবে আবাদ হবে। প্রকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় এলাকায় এ সব বাগান করা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
(দ্য রিপোর্ট/এআই/এসআর/এনআই/এনডিএস/এনআই/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৪)