৯ বছরেও স্থায়ী হয়নি চাকরি
বাংলালিংকের বিরুদ্ধে ১০৮ মামলা
আমিরুল ইসলাম নয়ন, দ্য রিপোর্ট : দেশের প্রচলিত শ্রম আইনকে অমান্য করে কর্মী নিয়োগ, অস্থায়ীদের স্থায়ীকরণ, চাকরিচ্যুতি, নিয়ম ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন-ভাতা বৃদ্ধি না করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি বাংলালিংকের বিরুদ্ধে। আর ফোন কোম্পানিটির এ সব অনিয়মের ফলে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ইতোমধ্যে কোম্পানির বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ১০৮টি মামলা।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পরবর্তীতে শ্রমআইন অনুযায়ী স্থায়ীকরণ না করা নিয়ে অনিয়মের সূচনা করে বাংলালিংক। কল সেন্টার, আইটি বিভাগ, টাওয়ার প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিভাগে অর্ধ সহস্রাধিক জনবল নিয়োগ দেয় বাংলালিংক। ছয় মাসের এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নিয়োগকৃতদের প্রচলিত শ্রমআইন অনুযায়ী কর্ম দক্ষতার ভিত্তিতে স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতিও দেয় কোম্পানিটি। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে এ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করিয়ে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় তাদের। আর এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে পদত্যাগ করায় স্থায়ী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। এভাবেই গত ৯-১০ বছর প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসছে বাংলালিংক।
ভুক্তভোগী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ছয় মাসের চুক্তিতে ২০০৯ সালে বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক প্রকৌশল বিভাগে নিয়োগ পাই। শর্ত ছিল এক বছরের মধ্যে আমাকে স্থায়ী করে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু ছয় মাস পরে দেখা যায় কোম্পানি আমাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে নতুন চুক্তিতে আবার নিয়োগ নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। এ সময় আমি পদত্যাগ না করে একবছরে স্থায়ী হওয়ার দাবি জানালে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, পদত্যাগ করে নতুন নিয়োগ না নিলে চুক্তি অনুযায়ী আমাকে চাকরিচ্যুত করে নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে। অবশেষে চাকরি হারানোর ভয়ে আমি পদত্যাগ করে নতুন নিয়োগ নিয়েছি। এভাবে এখনও চলছে বাংলালিংকে আমার চাকরি জীবন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলালিংকের এমন কৌশল অবলম্বনের কারণে প্রচলিত শ্রম আইনে তাদের আটকানো সম্ভব হয় না। আর আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে বাংলালিংক দীর্ঘদিন ধরে এমন অনিয়ম চালিয়ে গেছে। এ সব অনিয়মের কারণে আমরা কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য হই।’
জানা গেছে, চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দিয়ে বছরের পর বছর কোনো রকম সুযোগ সুবিধা ছাড়া চুক্তির মেয়াদ বর্ধিতকরণ এবং স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিয়েও স্থায়ী না করার জন্য কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। কথা ছিল আগের বকেয়াসহ নতুন সুযোগ সুবিধা দিয়ে স্থায়ীকরণ করা হবে, কিন্তু তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে শুধু স্থায়ীকরণ করেছেন, নতুন কোনো সুযোগ-সুবিধা তো দেয়ইনি বরং বকেয়া দেওয়া হবে না বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। বেশি সমস্যা তৈরি করলে কর্মচারীদের আবারও অন্য কোনো কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে বলেও হুমকি দিয়েছে তারা, যা শ্রমআইনের পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত কর্মচারীরা।
এদিকে চাকরি স্থায়ীকরণ, স্থায়ীদের সমান বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য দাবিতে বাংলালিংকের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে শ্রম আদালতে। অন্যদিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শর্তানুযায়ী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা ও আন্দোলন করার অভিযোগ এনে এই ১০৮ জনের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করেছে বাংলালিংক।
শ্রম আদালত সূত্রে জানা গেছে, বাংলালিংকের বিরুদ্ধে একে একে ১০৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রথম দফায় ৭৬টি, দ্বিতীয় দফায় ৭টি, তৃতীয় দফায় ৬টি এবং চতুর্থ দফায় ১৯টি মামলা দায়ের করেছে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এর আগে গত বছর নভেম্বর মাসে ভুক্তভোগী এ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলালিংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানবপ্রাচীর কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু তাদের এমন আন্দোলনে কর্ণপাত না করে উল্টো আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বেশ কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ।
বাংলালিংকের এক কর্মচারীর ভাষায়, ‘চাকরি করতে এসে রাজপথ ও আদালতে ঘুরতে হচ্ছে। এমন জীবন চাইনি। চেয়েছিলাম স্বাভাবিক জীবন। তা এখন ফিরে পাওয়া বহুদূর। ৯ মাসে চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ ৯ বছর পার হতে চলেছে, চাকরি স্থায়ী তো হয়ইনি বরং রাজপথে নামতে হয়েছে। তাতেও ফল পাইনি, তাই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’
জীবনের কথা ভেবে নাম প্রকাশ করেননি তিনি। এভাবে আকুতির কথা জানিয়েছেন আরও ১০ জন। তারা নিজের মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে শ্রম আদালতে মামলা করেছেন।
এদিকে মামলা-পাল্টা মামলায় ফোন কোম্পানিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ। আর সমঝোতার মাধ্যমে প্রথম ধাপে ৩০০ জনকে স্থায়ীকরণ করে তারা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বাংলালিংকের বিরুদ্ধে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থেকে স্থায়ী হওয়া বাংলালিংকের এক প্রকৌশলী বলেন, ‘যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় তারা প্রত্যেকেই কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তি। কিন্তু যখন স্থায়ী করা হয় তখন শুরু হয় জুনিয়র এক্সিকিউটিভ থেকে। এতে করে যাদের স্থায়ী করা হয়েছে তাদের কর্মকর্তা পদ দেওয়া হলেও বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে জুনিয়র এক্সিকিউটিভদের স্কেলে। ফলে আমাদের মতো স্থায়ী হওয়া কর্মকর্তাদের বেতন বেড়েছে এক থেকে দুই হাজার টাকা। আবার অন্যান্য স্থায়ী স্টাফদের যে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তাও আমাদের দেওয়া হয়নি। কিন্তু সমঝোতার সময় আমাদের শর্ত ছিল সকল সুযোগ-সুবিধা ও আগের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলালিংক তাদের শর্ত ভেঙেছে। তাই আমরা এখনও মামলা প্রত্যাহার করিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন স্থায়ী হলেও কিভাবে আমাদের প্রমোশন হবে, অবসর, স্বাস্থ্যবীমা, ইনক্রিমেন্ট কোনো কিছুই নিয়োগপত্রে উল্লেখ নেই।’
এ সব অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলা হলে বাংলালিংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাকারিয়া রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও স্থায়ীকরণ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা এখন আর নেই। কোম্পানি প্রায় ৩০০ জনের চাকরি স্থায়ী করেছে। আরও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জনের স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের সকল দাবি মেনেই এ সব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
স্থায়ী হওয়া কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জাকারিয়া বলেন, ‘হেল্প বীমা, গ্রাচ্যুয়িটি, প্রভিডেন্ড ফান্ডসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কিনা আমার জানা নেই।’
স্থায়ী করা হলেও কেন আন্দোলনকারীরা মামলা প্রত্যাহার করছে না জানতে চাইলে জাকারিয়া বলেন, ‘সমঝোতার সময় শর্ত ছিল মামলা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু শুধুমাত্র কোম্পানিকে হয়রানি করতেই তারা মামলা প্রত্যাহার করেনি।’
(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/এইচএসএম/এনআই/এএল/ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৪)