দুবলারচরে খেজুরতলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক!
সুন্দরবন থেকে কাজী জামশেদ নাজিম, দ্য রিপোর্ট : চারপাশে শুধু পানি আর গহীন জঙ্গল। বাঘের গর্জনও নিত্যসঙ্গী। সুন্দরবনের দুবলারচরের প্রতিদিনের চিত্র এটি। এই নির্জন দ্বীপে জীবিকার টানে প্রতিদিন আসেন হাজার হাজার মানুষ। আর আসেন গুটিকয়েক পর্যটক। সবার হাতেই মোবাইল ফোন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কারো মোবাইল ফোনেই নেটওয়ার্ক নেই। কথা বলতে হলে যেতে হবে নির্দিষ্ট এক খেজুরগাছ তলায়। কারণ দুবলার চরের শুধু সেখানেই মেলে মোবাইলের নেটওয়ার্ক।
দুবলারচর খেজুর গাছতলার দোকানদার বেলাল হোসেন বলেন, ‘চার বছর আগে খেজুর গাছতলায় মাছের ব্যাপারীদের আড়ত বসত। একদিন এক ব্যক্তি মোবাইল সঙ্গে নিয়ে মাছ কিনতে যান। এ সময় হঠাৎ তার মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। তখন থেকেই আবিষ্কার হয় ওই খেজুর গাছতলায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এর পর থেকে জেলে, শ্রমিক ও আগত পর্যটকরা ওই খেজুর গাছতলায় গিয়ে মোবাইলে কথা বলেন।’
বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোশিয়েশন (ক্র্যাব) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) এক বিশেষ ট্যুরে সাংবাদিক ও র্যাব সদস্যরা শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় দুবলারচর ভ্রমণে যায়। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সুন্দরবন-৯ লঞ্চটি পশুর নদীর মুখে প্রবেশ করা মাত্রই সবার মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে যায়। ১২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সবাই যখন দুবলারচরে পৌঁছায় তখন সবার মন খারাপ ছিল। ৬-৭ ঘণ্টা কারো সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পারায় সবাই বিষণ্ন হয়ে পড়ে। সবাইকে বিচলিত দেখে দুবলারচরে থাকা কয়েকজন মোবাইলে কথা বলার জন্য তাদের খেজুর তলায় যেতে বলেন। তখন সবাই সেখানে গিয়ে মোবাইলে কথা বলেন। দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদকও এ সময় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।
সফরে যাওয়া র্যাবের সাবেক মিডিয়া ইউংয়ের পরিচালক এম সোহায়েল (ডিজিএফআইয়ে কর্মরত) বলেন, ‘এটা সত্যিই অলৌকিক ঘটনা। ৬ ঘণ্টা মোবাইলের নেটওয়ার্ক না থাকায় আমরা সবাই বিচলিত। তারপর জেলেদের দেখিয়ে দেওয়া খেজুর তলায় গিয়ে মোবাইলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। বরিশাল ছাড়ার ১২ ঘণ্টা লঞ্চ ভ্রমণের পর সুন্দরবনে প্রবেশ করে দেখি মোবাইলে নেটওয়ার্ক নাই। আশপাশের বিস্তৃত এলাকায়ও মোবাইলের কোনো টাওয়ার নেই। তারপরও কীভাবে খেজুর তলায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় তা সবার অজানা।’
এ চরে শুধুই পুরুষের বসবাস। দুবলারচরের অন্য একটি নাম মরণচর। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ঝড়ে হাজার হাজার মানুষ সাগরে ভেসে যায়। বালুরচরে মরদেহের স্তূপ পড়ে ছিল। সেই থেকে ওই চরের নামকরণ হয় মরণচর। এ চরে কোনো নারীর বসবাস নেই। নেই কোনো শিশু ও বৃদ্ধের আনাগোনাও।
এ মরণচরে প্রতিবছর শীতকালে আশপাশের জেলাগুলোর জেলে ও শুটকি ব্যবসায়ীরা এসে বসবাস শুরু করেন। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
দুবলারচরে তারা ছোট ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। শীত শেষে মার্চ মাসে তারা ফিরে যান নিজেদের বসতভিটায়। রান্নাবাড়া, ঘর লেপাসহ সব কাজই করতে হয় পুরুষদের।
শফিকুল নামের এক জেলে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের গর্জন ও সিডর-আইলার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের এখানে আনা হয় না। আমরা এখানে এসে নিজেরা সব কাজ করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভাটার সময় মাছ ধরি। এখানে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম রেডিও। এ ছাড়া অবসরে গল্প-গুজব, তাস ও লুডু খেলে আমরা সময় পার করি।’
চরে জেলেদের অস্থায়ী ঘরের পাশাপাশি রয়েছে কোস্টগার্ডের তিনতলা একটি ভবন। এ ছাড়া রয়েছে একটি মসজিদ ও মন্দির। চা-নাস্তার জন্য রয়েছে তিনটি দোকান।
(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এনডিএস/জেএম/সা/ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৪)