আরিফ সোহেল, চট্টগ্রাম থেকে : একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনজিওর নাম ‘আমরাও পারি।’ সাগরিকায় ম্যাচ ড্র করার পর স্মৃতিহাতড়ে মনে পড়েছে সেই নাম। ওই নামের সম্পৃক্ততা-টেস্টের আসল পরীক্ষায় ‘আমরা পারি’ তাই প্রমাণিত হয়েছে পয়ন্তর সাগরিকায়।

সাঙ্গাকারা-চান্দিমালরা যেমন পারেন; তেমন পারেন শামসুর-ইমরুল-মুমিনুলরা। পারেন সেঞ্চুরির জবাব সেঞ্চুরিতে দিতে। পারেন শ্রীলঙ্কার (৫৭৮+৩০৫) রানের পর স্বপ্ন বাঁচানিয়া (৪২৬ + ২৭১/৩) রানে অবিচল থাকতে। টেস্ট ক্রিকেটের ৪৬৭ রানের টার্গেটের মোক্ষম জবাব দিতে। একটি বারও বাংলাদেশকে কক্ষচ্যুত মনে হয়নি। বরং বাংলাদেশ বাধ্য করেছে প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কাকে ড্র মানতে। সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম আবারও সাক্ষী হয়েছে একটি গৌরবময় ড্র’র। এটি এই ভেন্যুতে বেক টু বেক ড্রও বটে।

এমন ম্যাচ ড্র করে মুশফিকুর রহিম নিজেও আপ্লুত। ড্র’কেই জয় মানছেন প্রকারান্তরে। তবে বলেছেন একটু ঘুরিয়ে, ‘জয়ের সমান হয়তবা না। এর আগে টেস্টে আমরা যেভাবে আউট হচ্ছিলাম। সে জায়গাতে আমরা ইমপ্রুভ করেছি।’

শনিবার চট্টগ্রাম টেস্টের শেষদিন সবার আগেই উঠে আসবে মুমিনুলের নাম। সমুদ্রের বিশালায়ই তার জন্ম; কক্সবাজারে। বয়স মাত্র ২২ বছর ১৩২ দিন। টেস্টে অভিষেক ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই। প্রথম ইনিংসেই হাফসেঞ্চুরি। তাতে বুঝা গেছে তার সম্ভাবনার কথা। মাত্র ৭ টেস্ট খেলা মুমিনুলের এটি তৃতীয় সেঞ্চুরি। অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২ টেস্টেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন। এটি চট্টগ্রামে তার বেক টু বেক সেঞ্চুরি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এই সাগরিকায় ৯-১৪ অক্টোবর সিরিজের প্রথম টেস্টে মুমিনুল ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ১৮১ রান তুলেছেন প্রথম ইনিংসে। তারপর ঢাকায় আরেকটি; তা দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৬* রান। সেই মুমিনুলেই শনিবার আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়েছেন মুশফিক। তাই বলতে দ্বিধা করেননি, ‘বিরতির পর তাকে আর বলতে হয়নি কিভাবে খেলবে। নিজেই দায়িত্ব নিয়ে খেলছেন।’

গতানুগতিক আঙিক পাল্টে দিয়ে ব্যাটিং করেছেন মুমিনুল। সাকিব একটু অশান্ত ব্যাট চালালেও তাতে কোনো বিপদ দেখেনি সাগরিকা। এর আগে তামিম-শামসুররা যেভাবে ব্যাটিং করেছেন তাতে সচরাচর যে ব্যাটিং প্রাচুর্য উৎসুক-প্রফুল্লতা থাকে তা ক্রিকেটপ্রেমীরা দেখেননি। বরং টেস্ট মেজাজের নিরেট বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল শুরু থেকেই। তামিম-শামসুর জুটিপাক্কা ২ ঘণ্টা উইকেট আগলে থেকেই ড্রর দিকে নিয়ে গেছেন ম্যাচ। যেখানে রোমাঞ্চকর ধুন্ধুমার স্বপ্রণোদিত ব্যাটিং সৌন্দর্য ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। যেন পণ করেই খেলছেন তামিম-শামসুররা।

৭১ রানে প্রথম যুগলবন্দির অবসান হয়েছে ভিথানেজের বলে। তামিমের মাটি কামড়ানো ইনিংসের শেষ হয়েছে ৩১ রানে; খেলেছেন ১০২ বল। ১০ রান পর পেরেরায় বোনা বনেছেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান শামসুর। ১৩৬ মিনিট উইকেটে থেকে তিনি খেলেছেন ৯৮টি বল। করেছেন ৪৫ রান। এই জুটিপতনে কিছুটা বিচলিত হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তারপর ওই মুমিনুলেই যেন আলোর বাতিঘর খুঁজে পেয়েছেন। পরের জুটিতে আরেক সেঞ্চুরিয়ান ইমরুল কায়েস ভালোই থিতু হয়ে গেছেন উইকেটে। তার ব্যাটিংশিল্পের নাটকীয়তার লেশমাত্র ছিল না সেখানে। তারা ঠিক ওপেনিং জুটির মতো অভিন্ন থেকেছেন ম্যাচ বাঁচাতে। মরিয়া ছিলেন নিজকে খোলসে রেখে লুজ বলে রান নিতে। ভুল করলেই নির্মম পরাজয়ের বিষাক্ত ছোবল। বিষয়টি মাথায় রেখেই মমিন-ইমরুলে বাংলাদেশ ৫৩.৩ ওভার পার করে ফেলেছে। এখনও শতভাগ ফিট নন ইমরুল, একটু রানের দিকেই ঝুকেছিলেন সর্তক দৃষ্টি নিয়ে। দেড়ঘণ্টা পার; বলও ৬৬টি। সে সময়ে আবারও পেরেরার আঘাত। আঘাতে ঝরে পড়েছেন ইমরুল। তখন তার ব্যাটে ২৫ রানের ফলক। দলের ১৫১ রানে এই তৃতীয় উইকেটের পতনই ছিল; শ্রীলঙ্কার জন্য শেষ প্রত্যাশার একবিন্দু। বাকি গল্প মুমিনুল আর সাকিবের।

আশা জাগানিয়ার সাগরিকার বার্তাকে ফিরিয়ে ব্যাটেদলে দেননি ব্যাটসম্যানরা। বরং শ্রীলঙ্কার জন্য একটা নির্মম টেস্ট বানিয়ে ফেলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তাদের চওড়া ব্যাটে। যেখানে অনুশোচনা মোটা দাগে লিখা থাকবে- ‘কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। কোনো আরও আগে ঘোষণা নয়।’ সাঙ্গাকারাময় একটি টেস্ট ম্যাচ এমন হতাশায় সিক্ত হবে তা ভাবান্তরেও ছিল না শ্রীলঙ্কার। কারণ জেতার মতো গোলাবারুদ মজুত ছিল শ্রীলঙ্কার। কমবেশি ১০০ ওভারে ৪৬৭ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয়ার ঘটনা অনেকটা দুঃস্মৃতি হয়েই থাকবে সফরকারীদের। আসলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতায় এমন আগমনী প্রতিরোধের ভাষা জানা ছিল না। ঢাকার মুমিনুল-শামসুর-সাকিব-তামিমদের সঙ্গে বহুবর্নিল ফারাক চট্টগ্রামে। যদিও এমন ফলের জন্য সব দায়ই গেছে উইকেটের ওপর। স্পোর্টিং উইকেট না হওয়ায় বেশ হতাশ শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক আঞ্জোলো ম্যাথুস। বলেছেন, ‘এই উইকেটে কাল (বরিবার) থেকে আবারও টেস্ট ম্যাচ শুরু করা সম্ভব। এটা ব্যাটস্যমানদের স্বর্গ। তবে বাংলাদেশ যদি টার্গেটের পিছনে ছুটত তাহলে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারত। কিন্তু কোনো ইচ্ছাই ব্যাটসম্যানরা দেখাল না। আমরা আরও বেশি বোলিং করতাম বাংলাদেশ জয়ের জন্য খেলেনি। খেললে ম্যাচ জমে উঠত।’

সম্বর্ধিত ব্যাটারই নয়; অগ্রসর নেতা হিসেবে ব্যাট করেছে মুমিনুল। তাকে যথারীতি সাহস যুগিয়েছেন দেশসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। যে কারণে মারা বলে হাত চালাতে দেখে অনেকেরই চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। তার ইস্পাত দৃঢ় মনোবল উদ্যত ব্যাটের কাছে নতি স্বীকার করেছেন অবিরাম করা শ্রীলঙ্কান স্লোয়ার-পেসার বোলাররা। তাদের অবিচ্ছিন্ন ১২০ রানের সঙ্গে ১১৫ মিনিট পার করে দেয়ার মাধ্যমে টেস্ট-উপলব্ধির নতুন স্তরে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। সাকিব-মুমিনুলেরর ধীরগতির ব্যাটিং দেখেও লুটোপুটি খেয়েছেন দর্শকরা।

সাঙ্গাকায় সিক্ত সাগরিকায় জয় ছিল দিবা স্বপ্নের মতো। জয় নয়; ড্র’র স্লোগানমুখর একটি টেস্ট রেকর্ডবুকে অম্লান হয়ে থাকবে। টেস্ট ক্রিকেটেও পরিবর্তনের হাওয়া বইয়ে দিয়েছে সাগরিকা। হারের দুষ্ট চক্র থেকে বেড়িয়ে আসা ইঙ্গিত স্পষ্ট। উন্নতির সূচকগুলো উন্নয়নমুখ। এটা সম্ভব হয়েছে ক্রিকেটারদের অন্তর্নিহিত স্পৃহা থেকে। যে কথা মুশফিক বলেছেন, ‘এই প্রথম দেখলাম আমাদের ব্যাটসম্যানদের এত কমিটমেন্ট নিয়ে খেলতে। ইমরুল-সাকিব-মুমিনুল সবাই যেভাবে ক্রিজে থাকার চেষ্টা করেছেন। আমার মনে হচ্ছে ওয়ান অব দ্য ডমেনেটিং ড্র।’

ট্যাকটিস-টেকনিক, সুদৃঢ় সুতীক্ষ্ম মেধা-মননে অনিষ্পন্ন ম্যাচ রাখার কৌশলে জয়ী বাংলাদেশ। তাই মমিন-সাকিবদের সমীহ করতে ৫২ মিনিট আগেই শ্রীলঙ্কার ঘোষণা-‘না পারছি না।’ অবশ্য টেস্ট সিরিজের শিরোপামঞ্চ দখলে ছিল শ্রীলঙ্কারই। ঢাকা টেস্ট জয়ের রসদে যা ফুলেফেপে উঠেছে। মঞ্চ থেকে টেস্ট সিরিজের শিরোপা তাদের হাতেই শোভা পেয়েছে।

লন্ডন ‘টাইমস’-এ ১৯৩৭ সালে অন্ধ রাশান ঔপন্যাসিক নিকোলাই অস্ত্রভস্কি লিখেছেন, ‘বীরত্ব জন্মে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে; আর কঠোর অবস্থার ভিতর দিয়ে তার পরীক্ষা শুরু হয়।’ বাংলাদেশের শুরুটা ছিল তেমনই। তবে আগের মতো হতদরিদ্র-জীর্নদশা থেকে এই টেস্টে নতুন করে গোড়াপত্তন করতে হয়নি। বরং বিপদের চৌহদ্দি পেরুনো আলোতে আলোকিত ছিল চট্টগ্রাম টেস্টের পুরো ৫ দিন। ক্ষাণিকটা নির্ভার থেকে; অনুকম্পা অনুভব না করেই পরিশুদ্ধ ব্যাটিং অভিমুখে দলের স্কোর প্রসারিত করেছেন ব্যাটাররা।

ক্রিকেটে বাঙালি জীবনের কূপমণ্ডুকতা, মলিন্য ও দীনতাকে পিছে ফেলেছেন ব্যাটসম্যানরা তাদের প্রতিজ্ঞাদৃঢ় ব্যাটিংয়ে। আবারও প্রমাণিত হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট মানেই উত্থান-পতনের মেলবন্ধন। ঢাকা টেস্টের দুঃখের অনামিকার অন্ধকার কেটে গেছে; হয়েছে অরুনোদয় সমুদ্র কুলঘেঁষা সাগরিকায়। বাংলাদেশের এটা ৮৩তম টেস্ট ম্যাচে ১১তম ড্র। চট্টগ্রামে এটা চতুর্থ। এই সাগরিকায় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ১১টি। দারুণ এক পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য এটি।

ফলবন্তজীবন সূচনালগ্ন পার করছে সাগরিকা। এখানের ইতিহাস বিস্তৃততর হচ্ছে ক্রমাগত। ক্রিকেটীয় আইসিসির নয়া মেরুকরণে সুধামাধুরী মিশেল ক্রিকেট দাঁড়িয়েছিল অনেকটাই প্রান্তসীমায়। ঠিক সেই সময়ে এমন ড্র শুধু দেশহিতকর নয়; ক্রিকেট হিতকর ম্যাচ হিসেবে স্মৃতির ক্যানভাসে জ্বলজ্বল করবে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

শ্রীলঙ্কা : ৫৭৮ ও ৩০৫/৪ ডিক্লেয়ার।
বাংলাদেশ : ৪২৬ ও ২৭১/৩, ৮৪.৪ ওভার (মুমিনুল হক ১০০*, শামসুর রহমান ৪৫, সাকিব আল হাসান ৪৩*, তামিম ইকবাল ৩১, ইমরুল কায়েস ২৫; পেরেরা ২/৫৫)।
ফল : ম্যাচ ড্র। ম্যান অব দ্য ম্যাচ : কুমার সাঙ্গাকারা।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/ওআইসি/এএল/ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৪)