বেসরকারিকরণকৃত ১০১ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই
সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : বেসরকারিকরণকৃত ২২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০১টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর মধ্যে ৪৬টি প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম-ঠিকানাও পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৯৩ সালে বেসরকারিকরণ বোর্ড (বর্তমানে বেসরকারিকরণ কমিশন) গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল।
বেসরকারিকরণ কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রি-ইনভেস্টিগেশন করা হবে। যদি খুঁজে পাওয়া যায় আর কী। শিল্প মন্ত্রণালয় শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম দিয়েছে, কিন্তু কোনো ঠিকানা দিতে পারেনি।’
কবে নাগাদ তদন্ত শুরু করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছি।’
কমিশন ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ‘বেসরকারিকরণ বোর্ড’ গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা হয়। তবে কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিলের মতে, এ সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
বোর্ড গঠিত হওয়ার আগে বেসরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো কী অবস্থায় আছে, সেটা জানতে দুই দফায় (২০১২ সালে ৭৬টি ও ২০১৩ সালে ১০৫টি) মোট ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর সমীক্ষা চালায় কমিশন। সমীক্ষা চালাতে গিয়ে ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২২৭টি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করার কথা জানতে পারে কমিশন। তবে এর মধ্যেও ৪৬টি প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম-ঠিকানা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অবশিষ্ট যে ১৮১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর কমিশন সমীক্ষা চালিয়েছে সেগুলোর মধ্যেও ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই।
কমিশন জানায়, ২২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিসিআইসি’র আওতাধীন ৭৫টি, বিজেএমসি’র আওতাধীন ৪১টি, বিটিএমসি’র আওতাধীন ৩৯টি, বিএসএফআইসি’র আওতাধীন ৩৭টি ও বিএসইসি’র আওতাধীন ৩৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সমীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারিকরণ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জা আবদুল জলিল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এগুলো তো সব সরকারি সম্পত্তি। এগুলো কোথায় হারিয়ে গেল, কীভাবে নষ্ট হল? এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের ছিল, তারা কেউ এগুলোকে দেখে রাখেনি। সমীক্ষার মাধ্যমে এটি তুলে আনা হয়েছে, এখন এগুলোর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেবে কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান কিংবা সরকার।’
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশের সব শিল্প-প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে দুই-একটি ছাড়া প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বছরের পর পর ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দাতাগোষ্ঠীর পরামর্শে গত আশির দশক থেকে এ সব প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণ করা শুরু হয়। সরকারি অর্থের অপচয় হ্রাস, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল বেসরকারিকরণের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে ১৯৮২ সালে ‘দ্য নিউ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি’ প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীকারে বেসরকারিকরণ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে ১৯৯৩ সালে ‘বেসরকারিকরণ বোর্ড’ গঠন এবং বোর্ডকে আরও শক্তিশালী করতে এটাকে কমিশনে রূপান্তর করা হয়।
কমিশনের প্রথম দফায় সমীক্ষাকৃত ৭৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৪টি প্রতিষ্ঠান চালু ও ৩২টি বন্ধ রয়েছে। চালু প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২০টি লাভজনক ও ১৬টি লোকসান দিয়ে চলছে। ৭৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫২টি প্রতিষ্ঠানেরই দায়-দেনার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫টির কোনো দায়-দেনা নেই এবং ১৯টির এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য পায়নি কমিশন।
কমিশনের দ্বিতীয় দফায় সমীক্ষাকৃত ১০৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অবশিষ্ট ৫০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি প্রতিষ্ঠান চালু আছে, ১টি চালুর প্রক্রিয়াধীন, ১৭টি বন্ধ, ১টির নাম পরিবর্তন ও ১টির ব্যবসা পরিবর্তন এবং ৭টি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে কমিশন দেখতে পায় যে, অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বদল হয়েছে, কেউ ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন, কেউ ভাড়া বা লিজ দিয়েছেন, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সাইনবোর্ডসর্বস্ব, কোনো যন্ত্রপাতি নেই সেখানে, কোথাওবা বাইরে পাহারাদার আছেন।
অন্যদিকে অস্তিত্বহীন ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৩টিরই কোনো পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় খোঁজাখুঁজি করেও এ সব প্রতিষ্ঠানের কোনো সন্ধান পায়নি কমিশন।
অস্তিত্বহীন/খুঁজে না পাওয়া ৫৫টি প্রতিষ্ঠান : বেঙ্গল মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ (২৬৭ তেজগাঁও, ঢাকা), মাসুদ রাজা অ্যান্ড কোং (৭৫ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা), হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম এনামেল অ্যান্ড সিলিকেট ওয়ার্কস (৪ হাটখোলা, ঢাকা, বর্তমানে রাজধানী সুপার মার্কেট), এজাজ রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ (ঢাকা), এসএনএ ট্যানারি (ঢাকা), জলিল সোপ ওয়ার্কস-রহমান ট্রেডিং, ইস্টার্ণ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, পারুমা ইস্টার্ণ লিমিটেড, আফসার কটন (টঙ্গী), ফ্যাক্টো ইয়ামাগেন ইলেকট্রনিক্স (ঢাকা), মল্লিক ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি লিমিটেড (২৪২ তেজগাঁও, ঢাকা), এমএম অয়েল মিলস (চাকদাই, ফরিদাবাদ, নারায়ণগঞ্জ), এশিয়ান টোব্যাকো কোং (৫০-৫১ তেজগাঁও শিল্প এলাকা ঢাকা), ইস্টার্ণ ট্যানারি (চট্টগ্রাম), স্টার পার্টিকেল বোর্ড মিলস, ক্রিসেন্ট অয়েল মিলস (মোস্তফা ম্যানশন, দ্বিতীয় তলা, ৪৬ ইমামগঞ্জ, ঢাকা), এআর হাওলাদার জুট মিলস (মাদারীপুর, ফরিদপুর), নূর ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ লিমিটেড (নারায়ণগঞ্জ), মরিয়ম লিমিটেড পেপার প্যাকেটিং অ্যান্ড কনভার্টিং ফারুক ইন্ডাস্ট্রিজ (আদমজীনগর, নারায়ণগঞ্জ), স্টেপটোমিসিন প্রোডাক্টস, গোল্ডেন ম্যাচ ওয়ার্কস, আহমেদ সিল্ক মিলস (ডেমরা, ঢাকা), আলাউদ্দিন তাইওয়া (টঙ্গী), মেটেক্স কটন (ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ), মোহাম্মদী ক্যালেন্ডারিং (ঢাকা), বেঙ্গল কর্পোরেশন (ঢাকা), চাতাল ম্যাচ ওয়ার্কস (ঢাকা), ন্যাশনাল রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ (ঢাকা), বেঙ্গল রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ (ঢাকা), শোভেনুর ট্যানারি (চট্টগ্রাম), বাংলাদেশ পেপার মিলস, এশিয়াটিক ট্যানারি অ্যান্ড সু ফ্যাক্টরি, সিনথেটিক রিজাইন প্রোডাক্টস, আব্বাসি থ্রেড লিমিটেড (চট্টগ্রাম), ইস্টার্ণ টেক্সটাইল (চট্টগ্রাম), জরি টেক্সটাইল (চট্টগ্রাম), খুলনা ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড (খুলনা), সিরাজগঞ্জ কটন (সিরাজগঞ্জ), ড্রাম মেটাল লিমিটেড (তেজগাঁও, ঢাকা), ভিক্টরী জুট প্রোডাক্টস লিমিটেড (পলাশ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী), ওরিয়েন্ট ট্যানারি অ্যান্ড বোনস মিলস-বোনস ইউনিট (কুমিল্লা), রূপালী নূর, মেটাল প্যাকেজ লিমিটেড, জি এম স্টিলস লিমিটেড (নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম), কোহিনূর টোব্যাকো কোং (১৪৯-১৫৫ টঙ্গী শিল্প এলাকা), হোসাইন জুট মিলস লিমিটেড (নারায়ণগঞ্জ), বালাগাম ওয়ালা ভেজিটেবল প্রোডাক্টস (৭/৮ নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা চট্টগ্রাম), বাংলাদেশ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ (২০০ তেজগাঁও, ঢাকা), রহমত অয়েল মিল (৩৩৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা ঢাকা), ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (টঙ্গী), হাসনী বনস্পতি ম্যানুফেকচারিং কোং (হাটহাজারি রোড, চট্টগ্রাম), ব্রড বারলাপ ইন্ডাস্ট্রিজ (বেতকা, ঢাকা), ওনার ট্যানারি (ঢাকা), ড্রাই আইচ অ্যান্ড কার্বোলিক গ্যাস ইন্দো বাংলাদেশ লিমিটেড, ওমর ইন্ডাস্ট্রিজ (২০৮ বায়েজিদবোস্তামী রোড, শিল্পনগরী, চট্টগ্রাম)।
(দ্য রিপোর্ট/এসআর/শাহ/এইচএসএম/সা/ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪)