যেখানে পাখির রাজত্ব!
আব্দুল্লাহ শুভ, দ্য রিপোর্ট : দেখ আম্মু কত বড় পাখি! দেখ, দেখ! রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তার মাকে বলল মেহেদী হাসান। মায়ের সঙ্গে সাভার থেকে এসেছে সে। কতই বা বয়স হবে ওর। খুব বেশি হলেও ছয়! এরই মধ্যে পাখিদের জন্য আলাদা মমত্ব তৈরি হয়েছে ওর। ‘সংবাদপত্রে পাখিমেলার কথা জানতে পেড়ে বায়না ধরেছে পাখি দেখবে। তাই ওকে না নিয়ে এসে পারলাম কই’ বললেন মেহেদীর মা। তবে নিয়ে এসে যে তিনি ভুল করেননি সেটা তার কথাতেই বোঝা গেল। কারণ ছেলের পাখি দেখার ছলে পাখিদের সঙ্গে নিজের সময়টাও খারাপ কাটেনি তার।
এটাই ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া পাখি মেলা ২০১৪’র চিত্র। রবিবার শিশু-কিশোরদের পাশাপাশি বড়রাও মেতে ছিলেন বাহারি প্রজাতির পাখির সঙ্গে। সঙ্গে বিদেশি দর্শনার্থীদের আগমন মেলায় অন্য মাত্রা যোগ করে। পাখি দেখে মাঝে মধ্যেই তাদের মুখ থেকে নিসৃত বার বার ‘ওয়াও’ শব্দটা মেলার সাফল্যেরই ইঙ্গিত বৈকি! যেমনটা এসেছেন রবার্ট থমাস। ইংল্যান্ডের অধিবাসী তিনি। দৈর্ঘ্যে কোনোভাবেই ছয় ফুটের কম হবেন না। কিন্তু মেলায় এসে যেন নিজের দৈর্ঘ্যটা খুইয়ে বসলেন! শিশুসুলভ ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে পাখিদের দেখতে থাকেন।
‘আগেও এসেছি এখানে, এবার এসেছি বার্ড ক্লাবকে সাহায্য করতে। এখানে আসতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান লাগছে। খুব ভালো লাগে এখানে আসলে’ মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! জীবন্ত জাদুঘর বললেই বেশি মানানসই। একটা আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও এখানে যত প্রকার পাখ-পাখালির আবাস, তা বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। প্রতিশীতেই অতিথি পাখির আগমন ঘটে এ চিরসবুজ আঙ্গিনায়। যেন এটা তাদের হাজার বছরের চেনা কোনো আপন ভূমি। পাখির কলকাকলীতে মুখর হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রান্ত। নিজেদের অভয়ারণ্য যেন নিজেরাই ঘোষণা করে তারা। এটা তাদেরই রাজত্ব কিনা!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগত পাখির মধ্যে বেশির ভাগই হাঁস জাতীয়। এদের মধ্যে ফ্লাইফেচার, সরালি, জলকুক্কুট, পচার্ড, জলপিপি, পাতারি, গার্নিগী, কোম্বডাক, পাস্তামুখি কামপাখি নর্দানপিন্টেল অন্যতম। এ ছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট লগ্ন, নাকতা, নর্দানপিন্টেল, ছোটনগ, খঞ্জনা, লাল গুরগুটি, বামুনিয়া হাঁস, কাস্তে চড়া ও ছোট জিরিয়া প্রভৃতি পাখির অবাধ বিচরণ এখানে। সেপ্টেম্বর মাসে হিমালয়ের উত্তরের দেশ যেমন, সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াং ও নেপালে প্রচুর তুষারপাত হয়। তুষারপাতে টিকতে না পেরে তারা নাতিশীতোঞ্চ আবহাওয়ার অঞ্চল বাংলাদেশে আসে। আবার মার্চের শেষ দিকে আপন আলয়ে ফিরে যায়।
পাখিদের রাজত্বের ঘোষণা করতেই ২০০১ সাল থেকে এখানে প্রতিবছর পাখি মেলার আয়োজন করা হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ‘পাখ-পাখালি দেশের রত্ন, আসুন করি সবাই যত্ন’ উপপাদ্যে বেশ ঘটা করেই ‘পাখি মেলা ২০১৪’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলার আলো ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাপিয়ে বিদেশে। মেলাকে ঘিরে সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছিল দেখার মত। ক্যাম্পাসবাসী ছাত্রীরা যেন এ দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কারণ শাড়ি পরার মত উপলক্ষ্য আর কয়টা হয়? কেউবা টিয়া পাখির সঙ্গে সখ্যতা জুড়তে পরেন টিয়া রঙ্গের শাড়ি। বেচারি বক এ জন্য অভিমান করতে পারে ভেবে সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে সারা ক্যাম্পাসে পাখিদের জন্য গান গেয়ে বেড়ায় অনেকে!
সত্যিই অদ্ভুত জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস। পাখির সঙ্গে মানুষের এমন সখ্যতা সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। যেমনটা বললেন, পাখিমেলার আয়োজক কমিটি-২০১৪’র আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় চার হাজার মানুষ বাস করা সত্ত্বেও পাখিদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আগমন সত্যিই অবাক করার মত। ক্যাম্পাসবাসীদের কতটা আপন ভাবলে এটা হয় সেটাই ভেবে পাই না। মানুষের সঙ্গে পাখির এতটা বন্ধুত্ব আর কোথাও চোখে পড়েনি আমার। আমরা যেন আমাদের ওপর পাখির এ আস্থা ধরে রাখতে পারি।’
জাহাঙ্গীরনগরকে নিয়ে সবাই যে বেশ ভালো আছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হোক পাখি, হোক মানুষ। সবমিলিয়ে সবার একটাই চাওয়া, ভালো থাক জাহাঙ্গীরনগর তোমার পাখ-পাখালি নিয়ে।
(দ্য রিপোর্ট/এএস/এনডিএস/সা/ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৪)