বান্দরবানে নাব্যতা সংকটে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী
বান্দরবান প্রতিনিধি : পরিবেশ দূষণের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানচিত্র। সারাদেশের মতো বান্দরবানও এর বাইরে নয়। শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। নাব্যতা সংকটে নদীর মাঝখানে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। পলি জমে নদী দুটি এখন ভরাট হতে বসেছে। বিলুপ্ত হওয়ার পথে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর দুর্লভ মৎস্য সম্পদও।
দেশের সবচেয়ে পশ্চাতপদ জেলা বান্দরবান। এখানে ১১ নৃ-গোষ্ঠীসহ ১৪টি সম্প্রদায়ের বসবাস। পার্বত্য এই জেলার বিস্তৃতি ৪ হাজার ৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। এই জনপদের সুখ-দুঃখের সাথী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী। দুটি নদীকে ঘিরেই বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি মিলে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের জীবনধারণ।
এক সময় সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীপথ ছিল পাহাড়ি জনপদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। কিন্তু এখন দিন পাল্টে গড়ে উঠেছে সড়ক যোগাযোগ। তবে আজও রুমা, থানছি এবং আলীকদম উপজেলার দুর্গম গ্রামগুলোতে যেতে নৌকা লাগে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ নদী দুটি শুকিয়ে পলিতে ভরাট হতে বসেছে। শুষ্ক মৌসুমে নৌ চলাচল করতে খুবই কষ্ট হয়। নদীর মাঝপথে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-ছোট চর। কোথাও কোথাও একদম সরু হয়ে গেছে নদী দুটি। দেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি নদীগুলোর মধ্যে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী অন্যতম।
জেলার দুর্গম মিয়ানমার সীমান্তবর্তী আরাকান পাহাড়ের অংশ বিশেষ থেকে উৎপত্তি হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গিয়ে মিলিত হয়েছে খরস্রোতা সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী। তবে নদী দুটির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান ও পরিমাপ নেই। পরিবেশ দূষণের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানচিত্র। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিটিউটের জরিপমতে পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিবছর হেক্টরে ১০০ থেকে ১২০ টন মাটির ক্ষয় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইইসিএন সংস্থার মতে দুর্গমাঞ্চলে ১৯৬৪ হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মৃত্তিকা সম্পদ শতকরা ১৮ ভাগ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ভূমি অবক্ষয় সম্পর্কিত এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে মোট পাহাড়ি ভূমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি বর্তমানে ক্ষয়ের মুখে। প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি জুম চাষকেই এ জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। ১৯৯২ সালের জরিপ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
স্থানীয় বান্দরবান জেলা পরিবেশ আন্দোলন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আল ফয়সাল বলেন, নির্বিচারে বনাঞ্চল উজাড় ও পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা বাড়ছে বান্দরবানে। পলি জমি খরস্রোতা সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী দুটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানির উৎসস্থল প্রাকৃতিক ঝর্ণা, ঝিড়ি-ছড়াগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বিপর্যয় ঠেকাতে বৃক্ষ নিধন এবং পাহাড় কাটা বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
নির্বিচারে বনাঞ্চল উজাড়, জুম চাষ এবং অবাধে পাহাড় কাটার ফলে শুষ্ক ও রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপথ বান্দরবানও। অবাধে বনাঞ্চল উজাড় আর পাহাড়ের পর পাহাড় জুম চাষের ফলে পানির উৎপত্তিস্থলগুলো আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়ি ঝর্ণা ও ছড়াগুলো। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খরস্রোতা সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর উপর। একদিকে পাহাড় কাটার মহোৎসব এবং অপরদিকে বৃক্ষ নিধনের প্রতিযোগিতায় বান্দরবানে ইতোমধ্যে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নামে সরকারি দুটি রিজার্ভ বনাঞ্চলও প্রায় উজাড় হয়ে গেছে। পাশাপাশি চলছে অবাধে পাহাড় কাটা। আর এ দুটি কারণে বান্দরবানে ভূমি ধসের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ের মাটি ধুয়ে পলি জমে গেছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীতে। নদীর মাঝখানে জেগে উঠেছে ছোট বড় অসংখ্য চর। জেলা সদরের কালাঘাটা, উজানীপাড়া, বাজার এলাকা, ক্যাছিংঘাটা, ভাঙামুড়া, তারাছার মুখ এলাকায় সাঙ্গু নদীতে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। অন্যদিকে মাতামুহুরী নদীর চম্পাতলী, লামারমুখ, আলীকদম বাজার, পোয়া মুহুরী এলাকায় একাধিক ছোট বড় চর জেগেছে। নদী দুটির অধিকাংশ স্থানে দেখা দিয়েছে চর।
বান্দরবান মৃত্তিকা সংরক্ষণ গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুল ইসলাম প্রতিবেদককে জানান, পাহাড়ি জনপদে শুস্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা কম। তার উপর পাহাড়ি ঝিড়ি, ঝর্ণা ও খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত সাঙ্গু ও মাহামুহুরী নদী ক্রমশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। তার প্রধান কারণ বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড় কাটা এবং প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতি ও জুম চাষ। আগুন লাগিয়ে পাহাড়ের সমস্ত ঝাড় জঙ্গল ও গাছপালা পুড়িয়ে সবুজ পাহাড়গুলো ন্যাড়া করার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে মাটি ক্ষয় হয় এবং পরবর্তীতে গাছপালা না থাকায় ভূমি ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে পানির উৎসস্থল নষ্ট হচ্ছে, ক্রমশ নদী, ঝিড়িগুলো ভরাট হচ্ছে। পাশাপাশি সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছে। আর দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে স্থানীয়রা নানারোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিবিদ আলতাফ হোসেন জানান, অপরিকল্পিত চাষাবাদ এবং নির্বিচারে বনাঞ্চল উজাড় ও পাহাড় কাটার ফলে ভরাট হচ্ছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী। নদী দুটি নাব্যতা হারানোর প্রভাব বান্দরবানে কৃষি উৎপাদনেও পড়েছে। পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে এবং বিলুপ্ত হচ্ছে মৎস্য সম্পদ। এ কারণে বনাঞ্চল উজাড় ও পাহাড় কাটা বন্ধের তাগিদ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। এদিকে নাব্যতা হারালেও সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী ড্রেজিংয়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নদীগুলো ড্রেজিংয়ে সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
(দ্য রিপোর্ট/এএস/এপি/জেএম/এএল/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪)