অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী ও আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, চিত্রকলা এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাকে আধুনিক বাংলা লেখকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে গণ্য করতেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৬১ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা) নওয়াপাড়া থানার শিমুলিয়া গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার বাড়ি ছিল নওগাঁ জেলার গৌরনাইয়ে। পড়াশোনায় হাতেখড়ি বিখ্যাত কাঙাল হরিনাথের কাছে। বাবা মথুরানাথ মৈত্রেয় রাজশাহীতে ওকালতি করতেন। ১০ বছর বয়সে তিনি রাজশাহীতে বাবার কাছে চলে যান। তৎকালীন বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল (বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) থেকে ১৮৭৮ সালে এনট্রান্স এবং ১৮৮০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। ১৮৮৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৮৮৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বিএল পাশ করেন। এরপর তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
অক্ষয়কুমার ছোটবেলা থেকেই পত্রপত্রিকায় লিখতেন। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে তার পাণ্ডিত্য ছিল। দুই ভাষায় সাহিত্য নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু তার মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ইতিহাস। এফএ শ্রেণিতে পড়াকালে মেকলের ‘ক্লাইভ অ্যান্ড হেস্টিংস’ বইটি পড়ে বুঝতে পারেন এটি মিথ্যায় পূর্ণ। ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন।
১৮৯৯ সালে সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রানী ভবানী, সীতারাম, ফিরিঙ্গি বণিক প্রমুখকে নিয়ে ইতিহাস বিষয়ক প্রথম বাংলা ত্রৈমাসিক ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহাসিক গুরুত্বযুক্ত স্থান, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে তথ্যবহুল নিবন্ধ প্রকাশ করেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে বহু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ, কাহিনী ও লোককথা সংগ্রহ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে দিঘাপতিয়া রাজ পরিবারের কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও জনৈক স্কুলশিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ গবেষণা ও প্রাচীন নিদর্শনাদি সম্বন্ধে অভিন্ন আগ্রহের কারণে একত্রে মিলিত হন। বাংলার এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য তারা বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহী সফরকালে উদ্ধার করা প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে তারা ১৯১০ সালের এপ্রিলে রাজশাহী জাদুঘর (বর্তমান বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর) প্রতিষ্ঠা করেন। সোসাইটির পরিচালক হিসেবে ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী রেশমশিল্প বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি একাধারে এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও শিক্ষক ছিলেন। রাজশাহী পৌরসভার কমিশনার হিসেবেও কাজ করেন। ডায়মন্ড জুবিলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের পৃষ্ঠপোষকতাসহ অবৈতনিক প্রশিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের রেশম চাষ পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। বেশকিছু সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। একজন ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় ও আঁকিয়ে হিসেবেও তার সুনাম ছিল।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্দয়, উদ্ধত, স্বেচ্ছাচারী হিসেবে তুলে ধরে কলঙ্কিত করেছিল। সিরাজউদ্দৌলা (১৮৯৮) নামের গবেষণা বইয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেন। ১৯১৬ সালের ২৪ মার্চ এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক সভায় তিনি অন্ধকূপ হত্যা অলীক ও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যাচার বলে ভাষণ দেন। ১৯০৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং ১৯১১ সালে বিশিষ্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সমরসিংহ (১৮৮৩), সিরাজউদ্দৌলা (১৮৯৮), সীতারাম রায় (১৮৯৮), মীর কাসিম (১৯০৬), গৌড়লেখমালা (১৯১২), ফিরিঙ্গি বণিক (১৯২২) ও অজ্ঞেয়বাদ (১৯২৮)।
ভারতের ব্রিটিশ সরকার তাকে সিআইই (Companion of the Order of the Indian Empire) উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯১৫ সালে কায়সার-ই-হিন্দ স্বর্ণপদক লাভ করেন।
(দ্য রিপোর্ট/ওএস/ডব্লিউএস/জেএম/এজেড/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪)