আবু তৈয়ব, খুলনা : রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে চলতি মৌসুমের প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটক এসেছে মাত্র ১১ হাজার। একই সময়ে আগের মৌসুমে এ সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ।

এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে এমন ৫০ হাজার মানুষের জীবিকা। সরকার হারিয়েছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।

সুন্দরবন বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা জহির উদ্দিন জানান, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন ভ্রমণের মৌসুম। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত মাত্র ১১ হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। আগের মৌসুমে একই সময়ে প্রায় আড়াই লাখ পর্যটক এ বন ভ্রমণ করেন।

এই বিষয়ে সুন্দরবন পর্যটন সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম কচি জানান, গত বছর এই সময় তাদের ব্যস্ততার শেষ ছিল না। কিন্তু এবার অলস সময় অতিবাহিত করছেন। ভাড়া করা নৌযান নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়েছে। তাদের বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় বর্তমানে দেশী পর্যটকরা খুলনায় আসছেন। ভ্রমণের দিন দিয়ে নৌযান বুকিং করছেন।

অন্যদিকে নদী আর বনের মিশ্রণে মন মাতানো সুন্দরবন অযত্ন আর অবহেলায় সৌন্দর্য্ হারাতে বসেছে। গাছ কেটে বসতি স্থাপন, বনের মধ্যে অবৈধ নৌরুট, পশু-পাখির অবাধ চলাচলে বাধা দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। এতে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনটি।

বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেনসিং অর্গানাইজেশন (স্পারসো) সম্প্রতি ‘টাইম সিরিজ অ্যানালাইসিস অব কোস্টাল ইরোশন ইন দ্য সুন্দরবনস ম্যানগ্রোভ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে বনের পরিমাণ কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধভাবে বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটার কারণেই কমছে বনের অংশ।

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষণায় বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়া সুন্দরবন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন ভ্রমণের মৌসুম। কিন্তু চলতি মৌসুমের শুরু থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সুন্দরবনকে পর্যটকশূন্য করেছে। গত জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত অলস সময় অতিবাহিত করেছে পর্যটন খাতের কয়েক হাজার শ্রমিক। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য গত ৪ বছরে শুধু খুলনাতেই অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের অনেকেই ভ্রমণ মৌসুমে নৌযান ভাড়া নেন। তাই চার মাসের জন্য নৌযান ভাড়া করে এনে স্থানীয় এসব প্রতিষ্ঠান তা আবার পর্যটকদের কাছে ভাড়ায় দেয়। দেশ- বিদেশের পর্যটকরা এ সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করে ভ্রমণের ব্যবস্থা নেয়। এবারও এ সব প্রতিষ্ঠান নভেম্বরের আগে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় নৌযান ভাড়া করে নিয়ে আসে। ভ্রমণের জন্য অনেক বুকিংও ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য আসতে না পারায় সব বুকিং একের পর এক বাতিল হয়ে গেছে।

সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে।বনদুস্যরা বাঘ শিকার করায় এই সংখ্যা দিন দিন কমছে। একটি বাঘের চামড়া ২ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। আর এই কারণে চামড়ার লোভে বাঘ শিকারে রয়েছে সংঘবদ্ধ দল।

এই বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ভারত এবং বাংলাদেশ অংশে এই বাঘ গণনার কাজ চলবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বন বিভাগের উদ্যোগে ও ডব্লিউআইআই(ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া)-এর কারিগরি সহায়তায় প্রথমবারের মত সরকারি পর্যায়ে বাঘ পরিবীক্ষণ ও গণনার কাজ শুরু হয়েছে।

এদিকে পরিবেশ অধিদফতর ও বনবিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও বরগুনার পাথরঘাটায় সুন্দরবন থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপন করার পরিকল্পনা করেছে সরকার। জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপনের জন্য স্থান হিসেবে পাথরঘাটা উপজেলার গাববাড়িয়া চরকে নির্বাচন করা হয়েছে। জায়গাটি সুন্দরবনের পাশে ও বন প্রভাবিত এলাকা।

বন বিভাগের আপত্তিপত্রে বলা হয়, পাথরঘাটা ও এর পাশের সুন্দরবনে প্রায় ৬০ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচিত এলাকার পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে সুন্দরবনের অবস্থান। জাহাজভাঙা শিল্প স্থাপিত হলে ব্যাপক হারে পানি, বায়ু ও শব্দদূষণের কবলে পড়বে সাগর ও সুন্দরবন। এরপর বলেশ্বরতীরের ‘পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা শিল্প’ স্থাপন করা হবে—এমন তথ্য জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দিতে পরিবেশ অধিদফতরকে অনুরোধ করা হয়।

বন আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের রামসার কনভেনশন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোনো শিল্পকারখানা, ভারি ইমারত ও স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। সুন্দরবনের এক পাশে বাগেরহাটের রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে পরিবেশবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। এ ছাড়া সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে একটি অবৈধ নৌরুট চালু হওয়ায় বনের ক্ষতি হচ্ছে বলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। কিন্তু ওই রুটটি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বনের আরেক পাশে জাহাজভাঙা শিল্প গড়ে তোলা হলে নানামুখী দূষণের কবলে পড়বে সুন্দরবন। ৫২ দশমিক ২৪ একর জমির ওপর প্রস্তাবিত এই জাহাজভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের জায়গাটি থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ছয় কিলোমিটার। এর দক্ষিণে টেংরা, চরলাঠিমারা ও হরিণঘাটা নামে প্রায় ছয় হাজার হেক্টর আয়তনের তিনটি সংরক্ষিত বন রয়েছে। উত্তর দিকে রয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর আয়তনের বন বিভাগের সৃজিত শ্বাসমূলীয় বন। এই তিনটি বনে রয়েছে অসংখ্য শ্বাসমূলীয় বৃক্ষ এবং হরিণ, শূকর, মেছো বাঘ, গুইসাপসহ অসংখ্য বন্য প্রাণী।

(দ্য রিপোর্ট/এএ/এইচএসএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪)