প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট
তদন্ত নিয়ে লুকোচুরি
কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট : রাজধানীর লালবাগ কেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনার তদন্ত নিয়ে লুকোচুরি চলছে। এ ব্যাপারে কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। কেউ বলছেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলছেন হয়নি। ঘটনার পর ছয়দিন অতিবাহিত হলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখছে না। বরং এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লায় ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনায় ডিপিডিসি’র ১০ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে আরও তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ শো’র উদ্বোধন করেন।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত ডিপিডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম (নারিন্দা, এনওসিএস), এটিএম ফজলুল করিম (গ্রিড দক্ষিণ-২), শেখ মোহাম্মদ জিয়াউল হাসান (লালবাগ), মহিউল আলম (স্বামীবাগ), ডিউটি অফিসার সহকারী প্রকৌশলী রকিবুল হাসান (স্বামীবাগ), উপসহকারী প্রকৌশলী মসিদুল হক (নারিন্দা), উপসহকারী প্রকৌশলী আমির হোসেন (নারিন্দা গ্রিড) ও সাইদ আহমেদ (নারিন্দা, গ্রিড)। দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিস সহকারী এবং অভিযোগ তদারককারী আবদুল হাকিম (নারিন্দা) এবং লুৎফর রহমান (স্বামীবাগ)।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে বা দায়িত্বে অবহেলার কারণে ওই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছিল তা তদন্তে ওইদিনই ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক এ এস এম মনজুরুল এহসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়। তদন্ত টিমকে দু-এক দিনের মধ্যেই রিপোর্ট জমা দিতে বলা হলেও এ নিয়ে চলছে নানা লুকোচুরি। ঘটনার ৬ দিন পরেও অস্পষ্ট রয়েছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে কি হয়নি।
এ ব্যাপারে তদন্ত টিমের প্রধান এ এস এম মনজুরুল এহসানের সঙ্গে দ্য রিপোর্টের পক্ষে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা নিয়ে একেক সময় একেক কথা জানান এ প্রতিবেদককে।
বুধবার বিকেল ৪টার দিকে দ্য রিপোর্টের পক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এই প্রতিবেদক জানতে চান, আপনি গতকাল (সোমবার) দুপুরে বলেছিলেন তদন্ত রিপোর্ট জমা দিচ্ছেন...দিয়েছেন ঠিক আছে তো...?
জবাবে মনজুরুল এহসান বলেন, ‘ঠিক আছে। ওসব নিয়ে কথা বলতে পারব না।’
তদন্ত রিপোর্টে অভিযুক্তদের কোনো দোষ পাওয়া গেছে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ওটা ইচ্ছাকৃত নয়। তবে অবহেলা ছিল কারো কারো। যান্ত্রিক ত্রুটিও থাকতে পারে।’
তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘ভাই প্লিজ, এ ব্যাপারে আমি কথা বলতে পারব না।’
এ ঘটনায় কয়জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ১০ জন। পরে আরও তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।’
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে এ এস এম মনজুরুল এহসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এখন (বেলা ১টা ১১ মিনিট) তদন্ত রিপোর্ট এমডি সাহেবের কাছে জমা দিচ্ছি। ঠিক আছে পরে কথা বলি।’ এ কথা বলেই মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
এর আগের দিন সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তদন্ত টিমের প্রধান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘তদন্ত তো রেডি, জমা দেব লোক তো পাচ্ছি না। কারণ এখন অফিস টাইম পার হয়ে গেছে।’
তদন্ত রিপোর্ট ঢাকা পাওয়ার ডিডিস্ট্রবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) চেয়ারম্যান ও এমডির কাছে জমা দেওয়ার কথা কি না জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, ‘হ্যাঁ।’
এদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি বলেন, ‘রাতেই হয়তো জমা দেওয়া হবে। ঘণ্টা দুয়েক পরে ফোন দিয়েন, জানতে পারবেন।’
এদিকে তদন্তের ব্যাপারে কোনো কিছুই জানেন না ডিপিডিসির চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায়। তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’
এটা তো (তদন্ত রিপোর্ট) আপনার কাছে জমা হবে তাই না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘না তদন্ত সচিবের কাছে জমা হবে।’ এ ব্যাপারে তিনি এমডির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। সর্বশেষ মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মোবাইলে কথা হয় তার সঙ্গে। তদন্ত রিপোর্ট জমা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আজকের মধ্যেই জমা হবে আশা করি।’
গত রবিবার রাতে কবে নাগাদ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া আছে জানতে চাইলে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো বলেছিলাম আজকের (রবিবার) মধ্যেই দিতে। অপেক্ষা করছি, দেখা যাক। জমা হলে জানতে পারবেন।’
বুধবার বিকেলে ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন্স) মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তো তদন্ত টিমের কেউ নয়। এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না।’
পরে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ, তাই দু-এক দিনের মধ্যে হবে না। সময় লাগবে মনে হয়।’
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলামের মোবাইলে বারবার ফোন দিলেও বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মোবাইলে বুধবার সন্ধ্যায় একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করা হয়নি।
তবে ডিপিডিসি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত টিমের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার দুপুরে ডিপিডিসির এমডির কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও সেটি আবার ফেরৎ দেওয়া হয়েছে সংশোধনের জন্য। তবে প্রতিবেদনে কি ধরনের সুপারিশ রয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, তদন্ত টিমের প্রধান এ এস এম মনজুরুল এহসানের চাকরির বয়স গত সোমবার শেষ হয়েছে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন সচিবের কাছে জমা না হওয়া পর্যন্ত অবসরে যেতে পারছেন না তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিপিডিসির গঠিত তদন্ত টিমের সদস্যরা গত শনিবার লালবাগের ডিপিডিসির আঞ্চলিক কাযালয়ে অভিযুক্তদের ডেকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান চলাকালে ডিপিডিসির লালবাগ অঞ্চলে যারা দায়িত্বপালন করছিলেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ডিপিডিসি ছাড়াও সরকারের একাধিক সংস্থা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
(দ্য রিপোর্ট/কেএ/জেএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৪)