গাজীউল হক
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : সাহিত্যিক, গীতিকার ও ভাষাসৈনিক গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তার লেখা 'ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না' গানটি গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরি হতো।
গাজীউল হকের বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ও মা নূরজাহান বেগম গৃহিণী। তার পড়াশোনা শুরু মক্তবে। বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস থেকে ১৯৫১ সালে অনার্স ও ১৯৫২ সালে এমএ পাস করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি এক সঙ্গে ১১ পেপার আইন পরীক্ষা দেন।
কলেজে পড়াকালে অধ্যক্ষ ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে এসে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ঐ বছর কুষ্টিয়ার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কনফারেন্সে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের ঈশ্বরদী কনফারেন্সে উত্তরবঙ্গ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বগুড়া শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় থেকেই বগুড়ায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কাজ করেন। এ সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি ভুখা মিছিলে শরিক হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার আগেই এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠেছিলেন।
ভাষা আন্দোলন ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য আন্দোলনগুলোতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে রয়েছে- ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসেবে ও পরে জাতীয় পর্যায়ের লেখক এবং সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সরব ছিলেন নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও।
১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ের সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে যোগদান করেন। সর্বোচ্চ আদালতে একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জেলের কবিতা (১৯৫৯), এখানে ও সেখানে, একটি কাহিনী, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১), এগিয়ে চলো (১৯৭১), Bangladesh Unchained (১৯৭১), Media Laws & Regulation in Bangladesh (১৯৯২), মোহাম্মদ সুলতান (১৯৯৪) ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন (১৯৯৬)।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। উল্লেখযোগ্য হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তনে তাকে ও আরেক ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি 'বাংলাদেশ জাতীয় ব্যক্তিত্ব গবেষণা কেন্দ্র' তাকে রাষ্ট্রভাষা পুরস্কার পদক ও সম্মান স্মারক প্রদান করে৷ ১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমি থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন৷ ২০০০ সালে বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন উপদেষ্টা হিসেবে বিশেষ সম্মাননা স্মারক প্রদান করে৷ একই বছর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে মাতৃভাষা পদক পান৷ ২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' তাকে 'একুশে পদক' পুরস্কারে ভূষিত করেন৷ ২০০০ সালের ১০ জুলাই পান 'বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন' পুরস্কার ৷
এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০০৯ সালের ১৭ জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এএল/ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪)