সাড়ে তিন বছর আগে ‘পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন’ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগহীনতায় পণ্যের মোড়কীকরণে বাধ্যতামূলক পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

একটি সূত্র জানিয়েছে, শুরু থেকেই পলিথিন ব্যবসায়ীরা পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইনের বিরোধিতা করে আসছে। সংশ্লিষ্ট একটি পক্ষের বাধা ও মন্ত্রণালয়ের অনীহার কারণে আইনটি বাস্তবায়নে বিধিমালা প্রণয়ন করা যাচ্ছিল না। পাট মন্ত্রণালয়ও সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে প্রচারণায় কিছু সময় নেওয়ার কথা জানিয়েছিল।

গত বছরের শেষের দিকে আইনের অধীনে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এরপর ১ জানুয়ারি থেকে আইন বাস্তবায়নে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন অমান্যকারীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কথা বলছে মন্ত্রণালয়।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণী ভূষণ চৌধুরী এ বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, একটি আইন বাস্তবায়নের জন্য আগে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে হয়। আমরা সেই কাজটি এখন করছি। এরপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় যাব।

গত সাড়ে তিন বছর ধরে প্রচার-প্রচারণা, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের পর আবার কেন প্রচারণা- এ বিষয়ে সচিব বলেন, আগে বিষয়টি সেভাবে হয়নি। আমি এখানে এসেছিও নতুন।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইনের অধীনে বিধিমালা অনুযায়ী আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এরপর গত ৬ নভেম্বর মোবাইল কোর্ট আইনে ‘পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন’ অন্তর্ভুক্ত করে একটি গেজেট জারি করা হয়।

পরিবেশ বাচাঁও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা পলিথিনের বিরুদ্ধে বলে আসছি। পলিথিন বাতিল করতে হলে বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পণ্যের মোড়কে বাধ্যতামূলক পাটের ব্যবহার আইনটি করা হয়। এতদিনে এ আইনটি বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। পলিথিন দূর করে পাট খাতের বিকাশের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় এ আইনটি শিগগিরই বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৮ জুন মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। গরিব চাষির পাটের উৎপাদন নিশ্চিত করা, পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও সম্প্রসারণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এ আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনে সরকারি ও বেসরকারি খাতে পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০ কেজির চেয়ে বেশি পণ্যের মোড়কীকরণের ক্ষেত্রে এ আইন প্রযোজ্য।

কোনো প্রতিষ্ঠান এ আইন না মানলে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। পুনরায় আবার একই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

২০১১ সালে সে সময়ের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আশরাফুল মকবুল জানিয়েছিলেন, পণ্যের মোড়কীকরণে যারা পাটের ব্যবহার করবে না শিগগিরই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওই সময় আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতের মালিকদের অনাগ্রহের কথা জানিয়ে আশরাফুল মকবুল বলেছিলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সভাসহ বিভিন্নভাবে পাটের মোড়ক ব্যবহারে সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করেছি।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইন পাস হওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বেশ কয়েক দফা উদ্বুদ্ধকরণ সভা করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহারে রাজি হয়নি।

আইনটি বাস্তবায়নের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে চিনি পরিশোধনকারী এসোসিয়েশন, চিনি ডিলার ব্যবসায়ী, বাংলাদেশ অটো মেজর এন্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতি, রাইস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন, কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশন, ময়দা উৎপাদন ও রফতানিকারক সমিতি, বাংলাদেশ রাইস মিল মালিক এসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ব্যয়বহুল বলে তাদের অনেকেই পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহারে বিরোধিতা করেছেন।

বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল হুমায়ুন খালেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, এক হিসাবে দেখা গেছে, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে প্রতিবছর ৫০ থেকে ৫২ কোটি পিস পাটের বস্তা প্রয়োজন হবে। বিজেএমসি’র ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম। তিনি আরও বলেন, গত বছর খাদ্য ও কৃষি বিভাগের জন্য আড়াই কোটি পিস পাটের বস্তা সরবরাহ করা হয়েছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আইন বাস্তবায়নে সচিবের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা কমিটি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে খাদ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের (বিএফএসআইসি) সঙ্গে বৈঠক করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন তাদের চাহিদার প্রায় পুরোটাই পাটের মোড়ক ব্যবহার করেছে। খাদ্য অধিদফতর শতভাগ পাটের মোড়ক ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বীজ রাখার জন্য পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/এইচএসএম/এনআই/ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪)