দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে চীনের ইতিহাসের একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, তিনি কনফুসিয়াস। গত শতাব্দীর সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন পণ্ডিত মানব জাতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার সময় চীনের কনফুসিয়াসকে পঞ্চম স্থান দিয়েছেন। এ কথা বলা যায়, প্রত্যেক চীনার গায়ে কনফুসিয়াসের কম-বেশি প্রভাব আছে।

কনফুসিয়াস হলেন চীনের কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। দু’হাজার বছর ধরে চীনে কনফুসিয়ান তত্ত্বের প্রভাব শুধু রাজনীতি ও সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নয়, চীনাদের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণেও এর প্রভাব বিদ্যমান। কোনো কোনো বিদেশি পণ্ডিত কনফুসিয়ান তত্ত্বকে চীনের ধর্মীয় চিন্তাধারা মনে করেন। আসলে কনফুসিয়ান তত্ত্ব প্রাচীন চীনের মতবাদগুলোর অন্যতম মাত্র। এই তত্ব ধর্ম নয়, এক ধরনের দার্শনিক চিন্তাধারা। চীনে দু’হাজার স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে যথেষ্ঠ মর্যাদা দেওয়া হয়। কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা শুধু চীনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেনি, তার প্রভাব কিছু কিছু এশীয় দেশে বিস্তৃত। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে প্রবাসী চীনা আছে। কাজেই কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা চীন ও এশিয়ার সীমা ছাড়িয়েছে।

খ্রীষ্টপূর্ব ৫৫১ সালে কনফুসিয়াসের জন্ম। খ্রীষ্টপূর্ব ৪৭৯ সালে তার মৃত্যু। তার জন্ম গ্রীসের বিখ্যাত পণ্ডিত আরিস্টোটলের চেয়ে শতাধিক বছর আগে। কনফুসিয়াসের বয়স যখন তিন বছর, তার বাবা মারা যান। তিনি মায়ের সঙ্গে এখানকার পূর্ব চীনের সাংতুং প্রদেশে থাকতেন। কনফুসিয়াসের আসল নাম খুন ছিউ, কনফুসিয়াস হলো তার প্রতি সবার সম্মানসূচক ডাক। প্রাচীন চীনে একজনকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য লোকেরা তার পারিবারিক উপাধীর পিছনে ‘চি’ যোগ করতেন। কনফুসিয়াসের পারিবারিক উপাধী খুন, তাই সবাই তাকে খোন চি ডাকেন। কনফুসিয়ান চীনের ইতিহাসের বসন্ত-শরৎ যুগের লোক। এই সময়পর্বে আগের একীভূত রাজ্য ভেঙ্গে অনেক ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়। কনফুসিয়াস তখনকার লু রাজ্যের লোক। সেই আমলে লু রাজ্যের সংস্কৃতি সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

কনফুসিয়াস একজন বিদ্বান ব্যক্তি। প্রাচীন চীনে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়া শুধু অভিজাত পরিবারের সন্তানের অধিকার ছিল। কিন্তু কনফুসিয়াস এই ধরনের অধিকার ভেঙ্গে দেন। তিনি ছাত্রদের সংগ্রহ করে তাদের শিক্ষা দেন। যে-কোনো লোক শিক্ষার ফি হিসেবে অল্প কিছু খাবার বা অন্য জিনিস জমা দিলেই কনফুসিয়াসের ছাত্র হতে পারতেন। কনফুসিয়াস নিজের ছাত্রদের তার রাজনৈতিক মতবাদ ও নৈতিক চিন্তাধারা প্রচার করেন। জানা গেছে, কনফুসিয়াসের প্রায় তিন হাজার ছাত্রের মধ্যে বেশ কয়েকজন পরে বড় পণ্ডিত হয়েছিলেন। তারা কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছেন এবং তার বিকাশ করেছেন।

চীনের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে শাসক শ্রেণী কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাকে সমর্থন করেন। তার কারণ জটিল হলেও সংক্ষেপে বলতে গেলে কনফুসিয়াসের কড়া শ্রেণীবিভাগ চিন্তা আর রাজনৈতিক সংস্কারের চিন্তা শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তার এই সব চিন্তাধারা রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা আর সমাজের বিকাশের অনুকূল। কনফুসিয়াস মনে করেন নীচুস্তরের কর্মকর্তা-- উপরওয়ালার নির্দেশ লংঘন করা আর ছেলে বাবার কথা অনুসারে কাজ না করা গুরুতর অপরাধ। তার মতে, রাজাকে ভালো করে দেশ শাসন করতে হবে এবং সাধারণ অধিবাসীর রাজাকে মান্য করতে হয়। একজন লোক একই সময় মন্ত্রী, বাবা ও ছেলে হতে পারেন। তাকে বিভিন্ন অবস্থায় শ্রেণীবিভাগ ও পারিবারিক অবস্থান অনুসারে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এভাবে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

কনফুসিয়াসের মতবাদ সৃষ্টির প্রথম দিকে শাসক শ্রেণী তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর সময় চীন একটি একীভূত শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। শাসক শ্রেণী মনে করে কনফুসিয়াসের মতবাদ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে অনুকূল, তাই তার চিন্তাধারাকে রাষ্ট্রীয় মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

‘লুন ইয়ু’ নামক একটি বইয়ে কনফুসিয়াসের চিন্তাধারা ও আচার-আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইয়ে কনফুসিয়াসের বক্তব্য আর তিনি ও তার শিষ্যদের কথাবার্তাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রাচীন চীনে এই বই পাশ্চাত্য দেশের বাইবেলের মতো পবিত্র ছিল। বই সবার প্রয়োজন। একজন সাধারণ অধিবাসীকে এই বইয়ে লেখা আচার-আচরণ অনুসারে জীবনযাপন করতে হয়। একজন সরকারি অফিসারের পক্ষে এই বই পড়া আরও প্রয়োজনীয়। এই বই ভালো করে পড়েই শুধু যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা হতে পারেন। চীনের ইতিহাসে একটি কথা আছে, কনফুসিয়াসের মতবাদ সম্বলিত ‘লুন ইয়ু’ নামক বইয়ের অর্ধেক তত্ত্বই দেশ শাসনে যথেষ্ঠ।আসলে ‘লুন ইয়ু’ একটি একঘেয়ে তাত্ত্বিক বই নয়। তার আলোচ্য বিষয় সমৃদ্ধ, ভাষা প্রাণবন্ত। পাঠকরা এই থেকে কনফুসিয়াসের বুদ্ধি স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেন। এই বইয়ে বই পড়া, সংগীত, পর্যটন ও বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশাসহ নানা বিষয়ে কনফুসিয়াসের মন্তব্য আছে। ‘লুন ইয়ু’-তে কনফুসিয়াসের চি কোন নামক এক ছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করেন, সৈন্যবাহিনী, খাদ্যশস্য ও জনগণ– এই তিনটের মধ্যে যদি একটি বাদ দিতে হয়, তাহলে আপনি কোনটি বেছে নেবেন? কনফুসিয়াস কোনো দ্বিধা না করে উত্তর দিলেন, সৈন্যবাহিনীকে বাদ দেব।

কনফুসিয়াসের মতবাদ প্রাচীনকালের মতবাদ হলেও অনেক বিষয় আজ পর্যন্ত কাজে লাগে। ‘লুন ইয়ুতে’ কনফুসিয়াসের অনেক উক্তি চীনারা এখনও ব্যবহার করছেন, যেমন কনফুসিয়াস বলেছিলেন : ‘তিনজনের মধ্যে অবশ্যই আমার শিক্ষক আছেন’। কনফুসিয়ানের এই কথার অর্থ হল প্রত্যেকজনের গুণ আছে, কাজেই পরস্পরকে শিখতে হবে।

সূত্র : চায়না এবিসি

(দ্য রিপোর্ট/একেএম/ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪)