তারেক সালমান, দ্য রিপোর্ট : নাজুক বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো। সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়েও শীর্ষ নেতারা মাঠে না থাকায় হতাশা বিরাজ করছে তৃণমূলে। শীর্ষ নেতাদের বিশ্বাসও করতে পারছেন না দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ফলে আগের মতো সাড়া মিলছে না।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ও সিনিয়র নেতাদের সম্পর্কে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করেই বাধ্য হয়ে সম্প্রতি দলের সাংগঠনিক সফর স্থগিত করেছে বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম-মহাসচিবদের নেতৃত্বে গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এ টিমের কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু জেলাপর্যায় থেকে টিমের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে কার্যক্রম শুরুর আগেই স্থগিত ঘোষণা করে বিএনপি।

সারাদেশে বিএনপির মোট সাংগঠনিক জেলা ৭৫টি। এ সব জেলায় দলের সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে ৫৬টি কমিটি গঠন করেছিল দলটি।

এই সফরের মাধ্যমে দলের ভেঙে পড়া সাংগঠনিক কাঠামো পুনরুদ্ধার করে দলকে শক্তিশালী করা, নেতাকর্মীদের নতুন করে আন্দোলনমুখী করার পাশাপাশি আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে একক প্রার্থী নির্ধারণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয় এই সফর থেকে।

সূত্র জানায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বন্ধের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট (বর্তমানে ১৯ দলীয় জোট) অনির্দিষ্টকালের অবরোধ করে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচণ্ড বাধা ও ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পরও এ কর্মসূচি মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সফল করেন। অথচ দলে অভিযোগ রয়েছে, কর্মসূচি ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে দলটির ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতেও কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল শূন্য। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সে দিন রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করলেও দলের দাপুটে কোনো নেতাকেই সামনে পাননি তৃণমূল নেতাকর্মীরা। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তা এগিয়ে নিতে দলের শীর্ষ নেতাদের দিকনির্দেশনা না পেয়ে কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ে বলে দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সম্প্রতি প্রকাশিত ফোনালাপেও স্পষ্ট হয় দলের চেইন অব কমান্ডের দুর্বলতার বিষয়টি। গত নভেম্বরের শেষ দিকে বিএনপির কর্মসূচি ও শীর্ষ নেতাদের অবস্থান প্রসঙ্গ ছিল ফোনালাপের বিষয়। এ সময় দলের দুর্দিনে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আত্মগোপনে থাকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারেক রহমান। তিনি শমসের মবিনকে বলেন, ‘উনি (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) পালিয়ে থেকে লাভ কী হচ্ছে? বরং এতে কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।’

বিএনপির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেও বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে। তারা জানান, আগে কর্মসূচি সফল করতে পূর্ব থেকেই নেতারা বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিকনির্দেশনা দিতেন। সে মোতাবেক কাজও করত কর্মীরা। বর্তমানে দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাদের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা মিলছে না।

বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুল মান্নান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বর্তমানে সংগঠনের কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। মামলা ও সরকারের রোষানল থেকে বাঁচতে সংগঠনের সিনিয়র নেতারা দীর্ঘদিন থেকেই ছিলেন আত্মগোপনে। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গেও তাদের ছিল না কোনো ধরনের ন্যূনতম যোগাযোগ। সে কারণে আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা পাই নাই। এ কারণে জানি না আমাদের কী করা উচিত।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে সারাদেশে কমিটি গঠন করা হলেও নেতাদের সঠিক ‘মনিটরিং’ না থাকায় তার কোনো কার্যকারিতা ছিল না। নির্বাচন প্রতিহতে দেশে যা কিছু হয়েছে, তা স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের নিজস্ব কৌশল ও প্রচেষ্টাতেই হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনা স্থানীয় নেতাদের দেওয়া হয়নি।

বিএনপির বিভাগীয় ও জেলাপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও আন্দোলনে শীর্ষ নেতাদের কোনো ভূমিকা না থাকায় চাপা ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। টাঙ্গাইল-৭ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তী বলেন, গত আন্দোলনে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দলের শীর্ষ নেতাদেরও সেভাবে সাড়া দিয়ে আন্দোলন সফল করা প্রয়োজন ছিল। কেন্দ্রের দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপির আন্দোলন তৃণমূলে শতভাগ সফল। ঢাকায় হয়ত কিছুটা ব্যর্থতা দেখা গেছে। তবে আন্দোলন হবে। আন্দোলনের মুখেই সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামিয়ে বেশি দিন বিএনপির নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখতে পারবে না তারা।

তবে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ার বিষয়টি মানতে রাজি নন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের মতে, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করে রাজধানীতে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে সরকার। দলের সদর দফতরে পুলিশি তল্লাশি ও ভাঙচুর, নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার, জামিন না দেওয়া, কর্মসূচি বানচালে সরাসরি গুলি, দ্রুত বিচার আদালতে মামলাসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে সরকার। রাজধানীতে বিভিন্ন বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করে দলের কোনো কর্মসূচিতে কাউকে রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান সরকার দেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। সুষ্ঠু রাজনীতি করার মতো অবস্থা বর্তমানে দেশে নেই। নির্যাতনে বর্তমান সরকার ব্রিটিশ আমলকেও হার মানিয়েছে। সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে মাঠে নামতে পারেনি নেতাকর্মীরা। তবে এমন করে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। এভাবে নির্যাতন করে কোনো সরকার বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি।

(দ্য রিপোর্ট/টিএস/এইচএসএম/সা/এএল/ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৪)