দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ভালোবাসা মানুষের পরমার্থিক প্রকাশ, শরীর-মনের যৌথ ক্রিয়া। নানারূপে প্রকাশিত ভালোবাসা সমাজের ঐহিক ও পরমার্থিক সম্পর্কের বন্ধন টিকিয়ে রেখেছে। যদিও ভালোবাসার প্রকাশ কোনো দিনক্ষণ মানে না। দিবসের ছড়াছড়িময় এ সময়ে সে ভালোবাসাও বাদ যায়নি। প্রতিবছরের মতো আবারও ফিরে এলো ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ১৪ ফেব্রুয়ারির আগের দিন বাংলাদেশে পালিত হয় পহেলা বসন্ত। উৎসবপ্রিয় নাগরিকরা একসঙ্গে পেয়ে যান পরপর দুটি উপলক্ষ।

ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্টান ধর্মের একজন সন্ন্যাসীর নাম। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ও দিবসটি নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ২৬৯ সালে ইতালির রোমে খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেইটাইনকে ধর্ম প্রচারের অভিযোগে সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস বন্দি করেন। বন্দি অবস্থায় তিনি এক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েকে সুস্থ করে তোলেন। এ ঘটনায় ভ্যালেইটাইন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এতে রাজা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ভ্যালেইটাইনের স্মরণে দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন।

আরেকটি কাহিনী হলো- ২৬৯ সালে সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াসের সেনাবাহিনীতে সেনা সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে তরুণদের আগ্রহ ছিল কম। তিনি দেখতে পান, বিয়ে বা যুগলবন্দি এই অনাগ্রহের কারণ। তাই যুবকদের বিয়ে বা যুগলবন্দি হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যুবক ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গির্জায় গোপনে বিয়ে পড়াতে থাকেন। বিষয়টি জানতে পেরে সম্রাট তাকে গ্রেফতার করান। কারারুদ্ধ হওয়ার পরও যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। এ সময় এক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়ের প্রেমে পড়েন ভ্যালেন্টাইন। তার আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। এ সব ক্ষমতার কথা জানতে পেরে রাজা তাকে রাজকার্যে সাহায্য করতে বলেন। কিন্তু বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগিতায় অস্বীকৃতি জানান ভ্যালেন্টাইন। ক্ষুব্ধ রাজা ২৭০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুর আগে প্রেমিকার কাছে চিঠি লেখেন এবং বিদায় সম্ভাষণে লেখেন ‘ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’।

এই ঘটনায় নিছক নর-নারীর প্রেম ছাড়াও ধর্মীয় তাৎপর্য আছে। কালক্রমে সেটি হারিয়ে যায়। ধর্মীয় চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে। ইংল্যান্ডে পিউরিটানরাও এক সময় এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে বর্তমানে গোটা বিশ্বেই দিবসটি পালিত হয়।

বাংলাদেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে গত শতকের শেষ দশক থেকে। ১৯৯৩ সালে দিবসটি বাংলাদেশে প্রথম পালন শুরু হয়। দিবসটি জনপ্রিয়তা পায় সাংবাদিক শফিক রেহমান ও তার ‘যায়যায়দিন’ নামের সাপ্তাহিকের মাধ্যমে। ওই সময় পত্রিকাটি প্রকাশ করত ভালোবাসা দিবসের বিশেষ সংখ্যা, যাতে পাঠকদের অভিজ্ঞতা স্থান পেত। এর ধারাবাহিকতায় দিনটি ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক আকার পায়। বিশেষ করে মিডিয়া ও পত্রিকা দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।

দিবসটির আগের দিন বাংলা ঋতু বসন্তের প্রথম দিন। এই দিনটিও উৎসব আকারে পালিত হয়। মূলত তরুণ-তরুণীরা দিন দুটিকে নানা আয়োজনে পালন করে। কার্ড, ফুলসহ নানা ধরনের উপহার বিনিময় করে। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই দুটি দিনে মেলায় উপচেপড়া ভিড় থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন আড্ডার স্থান ও রেস্টুরেন্টে তরুণ-তরুণীদের ভিড় লক্ষ্যণীয়। এক সময় দিনটির উদযাপন শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আকর্ষণীয় আয়োজন ও অফার দিয়ে থাকে।

তবে সামাজিকভাবে দিনটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। এর পেছনে যুক্তি হলো- এটি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছুই নয়। বাংলাদেশের সমাজে এর যৌক্তিকতা নেই। অন্য একটি যুক্তি হলো- এই দিনে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার কথা প্রচার করা হয়। অথচ পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী অর্থাৎ ভালোবাসার সর্বজনীন ও পরমার্থিক দাবিটি উপেক্ষিত থাকে। অবশ্য অনেকে বলেন, এ অভিযোগ পুরোপুরি ঠিক নয়। আরো বলা হয়, দিবস পালনের মাধ্যমে মনে হয় ভালোবাসা যেন একটি দিনে সীমাবদ্ধ। তারা সমাজে বিদ্যমান অশান্তির অভিযোগও তোলেন।

দিনটি নিয়ে রাজনৈতিক অভিযোগ হলো- এই দিনে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ঢাকায় ১০ জন শহীদ এবং শতাধিক আহত হন।

এসব তর্ক-বিতর্কের মধ্যেও দিনটি সরবে পালিত হচ্ছে। এর নেতিবাচক দিকগুলো যেমন মনে রাখা দরকার, একই সঙ্গে যেন ইতিবাচক বিষয়গুলো উপেক্ষিত না হয়।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এজেড/ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৪)